সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কার জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টায় ভারত

প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২২; সময়: ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ |
সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কার জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টায় ভারত

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভারত ও চীন। এর অন্যতম কারণ হলো— ভারত মহাসাগরে দ্বীপরাষ্ট্রটির কৌশলগত অবস্থান।

যদিও জনতম ইঙ্গিত দেয় যে, চীন সেখানে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কলম্বোতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট ভারতকে একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।

এ সুযোগে ভারত দেশটিতে যেভাবে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে তা উঠে এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক বিশ্লেষণে।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকট পার করছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের কারণে মানুষ নেমে এসেছেন রাস্তায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

তার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বিক্ষোভকারীদের। পরে রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি বলেন, ভালোর দিকে যাওয়ার আগে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়বে।

এ জন্য তিনি ভারতসহ বিশ্বের কাছে আর্থিক সহায়তা চান।

ভারত কখনওই শ্রীলঙ্কাকে ঋণদাতা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল না। কলম্বোর যা বিদেশি ঋণ তার সামান্যই দিল্লির কাছ থেকে নেওয়া। অন্যদিকে চীন শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে।

অর্থনৈতিক সংকট যখন ধীরে ধীরে ২০২১ সালে ঘনীভূত হচ্ছিল তখন শ্রীলঙ্কার সরকার বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় চীনের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ইউয়ান (১৪৮ মিলিয়ন ডলার) কারেন্সি সোয়াপ সুবিধা পেয়েছিল। তবে ভারত ধীরে ধীরে সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা দেওয়া অন্যতম দেশ হিসেবে উঠে আসছে।

কলম্বোর এখন বিদেশি ঋণ ৫১ বিলিয়ন ডলার (৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড)। এর মধ্যে তাকে চলতি বছর ৭ বিলিয়ন ডলার শোধ করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি আরও ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জরুরি ঋণ চায় জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় আমদানির দাম পরিশোধের জন্য।

এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক কলম্বোকে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। আর ভারতও শ্রীলঙ্কাকে ১.৯ বিলিয়ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানি পণ্যের দাম পরিশোধের জন্য দিতে পারে ভারত।

এছাড়া ভারত ৬৫ হাজার টন সার ও চার লাখ টন জ্বালানি দিয়েছে কলম্বোকে। মে মাসে আরও জ্বালানি দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দিল্লি চিকিৎসা সরঞ্জামও দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিনিময়ে, ভারত একটি চুক্তি করেছে যা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনকে ব্রিটিশ-নির্মিত ট্রিনকোমালি তেল ট্যাঙ্ক ফার্মে প্রবেশের অনুমতি দেয়। আর এ ট্রিনকোমালির কাছেই একটি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির লক্ষ্য রয়েছে ভারতের।

শ্রলীঙ্কার অনেকের মত হচ্ছে, কলম্বোতে ভারতের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ‘সার্বভৌমত্বের ক্ষয়’।

ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির পাবুদা জয়াগোদা বলেন, গত দেড় বছর ধরে সংকটে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। হ্যাঁ, দেশটি কিছু ঋণ, ওষুধ ও খাবার দিয়েছে কিন্তু তারা আমাদের বন্ধু হচ্ছে না। এখানে একটি অদৃশ্য রাজনৈতিক মতলব রয়েছে।

তবে অনেকেই ভারতের সাহায্য করার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন।

কলম্বোয় পেঁয়াজ আমদানিকারক ভি রত্নাসিংহাম বলেন, আমাদের সংকটের জন্য ভারতকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। আমরা এখনও ভারত থেকে পেঁয়াজ পাচ্ছি স্বল্প মূল্যে এবং সংকটের সময়ে তারা আমাদের ঋণ দিচ্ছে। আর পেঁয়াজের দাম তিনগুণ বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা।

চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের কারণে মূলত ভারতের মতলব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

মাহিন্দা রাজাপাকসে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশায়’ কলম্বো চীনের দিকে ঝুঁকতে থাকে। হাম্বানটোটা বন্দর ও কলম্বো-গল এক্সপ্রেসওয়ের মতো মাল্টিবিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের দায়িত্ব পায় চীন। এর পর ২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রথমবারের মতো কলম্বো সফর করেন। এটি দিল্লির জন্য একটি স্পষ্ট কূটনৈতিক বার্তা ছিল।

হাম্বানটোটাকে এখন ‘শ্বেত হস্তি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে— যা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে রক্তাক্ত করছে।

গল ফেসের বাসিন্দা ৪৪ বছর বয়সি নোরা নুর বলেন, সমস্ত চীনা অর্থ যা এসেছিল তার জন্য কখনও হিসাব করা হয়নি, তাই না? অন্যথায় কেন আমার দেশ অর্থপ্রদানে খেলাপি হবে? এখন সব সরবরাহ আসছে ভারত থেকে। সুতরাং আমার প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কাকে বিশ্বাস করব, ভারত না চীনকে?

তবে অনেকেই এখনও আশাবাদী কূটনীতি এ সংকট নিরসনে সহায়তা করতে পারে।

ভারতে শ্রীলঙ্কার সাবেক হাইকমিশনার অস্টিন ফার্নান্দো মনে করেন, শ্রীলঙ্কা কি চীনের সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর পথে রয়েছে? যদি তাই হয়, তবে আমাদের এমন পরিস্থিতি যেভাবেই হোক এড়াতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক জরুরি।

ভারতও শ্রীলঙ্কায় চীনের আধিপত্য ঠেকাতে প্রচুর চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরের বছর শুধু কলম্বো সফর করেছেন তা নয়, তিনি শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে নিজেকে ‘সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ হিসেবে দাবি করেছেন।

শ্রীলঙ্কার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা সাবেক ক্রিকেটার অর্জুনা রানাতুঙ্গার মতে, তিনি দায়িত্ব পালনের সময় ভারত উদার ছিল।

তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি পেট্রোলিয়াম ও বন্দর মন্ত্রণালয় সামলাতাম এবং সেসময় আমরা জাফনা বিমানবন্দর তৈরি নিয়ে অর্থের অভাবে ছিলাম। আমি দিল্লি গেলাম সাহায্যের জন্য। প্রধানমন্ত্রী মোদির সরকার ভর্তুকিযুক্ত ঋণের প্রস্তাব দিয়েছিল এবং পরে এটিকে অনুদানে রূপান্তরিত করেছিল। প্রতিবেশীর কাছে আপনি আর কী আশা করেন?’

২০১৯ সালে রাজাপাকসে ভাইয়েরা ক্ষমতায় আসেন। গোটাবায়ে প্রেসিডেন্ট ও মাহিন্দা হলেন প্রধানমন্ত্রী। এর পর ভারতের সঙ্গে তেল ও খাদ্য সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু চুক্তি তাড়াতাড়ি হয়েছিল। চীনের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে দিল্লি-কলম্বোর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সফর অনুষ্ঠিত হয়।

এসব সফরে আলোচনার অগ্রভাগে ছিল তামিল সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রসঙ্গ। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারত শ্রীলঙ্কার সরকারের প্রতি সমর্থন বাড়ায়। যদিও শ্রীলঙ্কা ১৯৮৭ সালে ভারতের সঙ্গে হওয়া ইন্ডিয়া-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটে ভারতের সহায়তা শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের মনোভাবে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে।

সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস ইন কলম্বোর জ্যেষ্ঠ গবেষক ভাবানি ফনসেকা বলেন, ‘ভারত চীনের কাছে ১৫ বছর আগে হেরে গিয়েছিল কিন্তু একটি সুন্দর প্রত্যাবর্তনের জন্য দেশটি কঠোর চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো সম অধিকার বাস্তবায়নের জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘তবে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের নাক গলানোর কারণে অনেকেই উদ্বিগ্ন। তবে আমি মনে করি, শেষ কয়েক সপ্তাহে এ মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে গেছে’, যোগ করেন ভাবানি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে