উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ কোটি ডলারের শ্রম হারাবে এশিয়া

প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২০; সময়: ১:১৮ অপরাহ্ণ |
উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ কোটি ডলারের শ্রম হারাবে এশিয়া

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ কোটি ডলারের শ্রম হারাবে এশিয়া
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে জিডিপি ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে, যার আর্থিক ক্ষতির অংক দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার। আর সমগ্র এশিয়ায় ২০৫০ নাগাদ প্রতিবছর চার লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারের শ্রমমূল্য সৃষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উপযোগ হারিয়ে যাবে জিডিপি থেকে।

জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর চিরায়ত বাস্তুসংস্থান এবং প্রাকৃতিক চক্র বিনাশী এক দানব। মানবজাতির অপরিণামদর্শী দূষণের কারণেই এই বিপর্যয়কর পরিণতি নেমে আসছে। এরসঙ্গে আরো দায়ি; ভোগবাদি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার জয়-জয়াকার আর দেশে দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পদের অসম বণ্টন।

কোভিড-১৯ মহামারি যেমন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিকে অবদমন করেছে, ঠিক তেমনি বিশ্বের সব খাতই মোকাবিলা করছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব।

ইতোপূর্বে, ২০১৯ সালের আগস্টে অর্থনৈতিক রেটিংস সংস্থা মুডিস জানিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ ১০০ লাখ কোটি ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হবে বিশ্ব। এসময় বিশ্বের তাপমাত্রা প্রথম শিল্প বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের চাইতে দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে; ক্ষতি ৭৭ লাখ কোটি এবং ২ ডিগ্রী বাড়লে তা ১০০ লাখ কোটি ডলার হবে বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি।

উদোর পিণ্ডি যেমন বুধোর ঘাড়ে চাপে- ঠিক তেমনি উন্নত বিশ্বের মুক্ত বাণিজ্য আর অবাধ শিল্প দূষণের ফলে সৃষ্ট এ পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো। যার মধ্যে; বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে উষ্ণায়ন জীবন ও জীবিকাকে করবে বিপর্যস্ত। কমাবে অর্থনীতিতে বিপুল মূল্যের শ্রম শক্তির অবদান।

মার্কিন বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোং-এর গবেষকরা চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানান, এর ফলে সমগ্র এশিয়ায় ২০৫০ পর্যন্ত প্রতিবছর চার লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারের শ্রমমূল্য সৃষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উপযোগ হারিয়ে যাবে জিডিপি থেকে।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে জিডিপি ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে, যার আর্থিক ক্ষতির অংক দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মারাত্মক তাপপ্রবাহ, ক্ষরা, বন্যা এবং সামুদ্রিক ঝড়ের প্রকোপ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরিণত হবে আরো নিত্য-নৈমেত্তিক ঘটনায়।

পৃথিবীর অন্য যে কোনো অঞ্চলের চাইতে এর ফলে এশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে। আর জনসংখ্যা ঘনত্ব এবং ভৌগলিক অবস্থানের ফলে প্রভাবটা বেশি পড়বে দক্ষিণ এশিয়ায়।

এ অঞ্চলে দরিদ্রদের সংখ্যাও বেশি হওয়াটা অর্থনৈতিক ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ। সস্তা ও শ্রমঘন শিল্প এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগের উপর নির্ভর এ অঞ্চলের বৃহত্তর শ্রমবাজার। কিন্তু, ভূভাগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি যেমন প্রচণ্ড উত্তাপের জন্ম দেবে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়বে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ। দমবন্ধকর এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমিক ও দিন-মজদুর।

জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে কাজ করতে তারা বাধ্য, কিন্তু দূর্বিষহ উত্তাপ আর বাতাসে জলীয় কণা বেশি থাকার গুমোট পরিবেশে তারা সহজেই ক্লান্ত হবেন। কর্মস্থলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়বে।

ইতোপূর্বে এমন ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিল ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদন। সেখানে তাপমাত্রার প্রকোপে দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশের শ্রমিকদের মধ্যে ক্লান্তি, অবসাদ বৃদ্ধির কথা যেমন বলা হয়েছে- তেমনি আছে মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধির কথাও।

সংস্থাটি জানায়, ক্লান্তি ও অবসাদের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ কর্মঘণ্টা হারাবে। ১৯৯৫ সালে এ অনুমান করা হয়েছিল ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।

হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান এ শ্রমঘণ্টা দেশে ১৯৯৫ সালের হিসাবে ২২.৭৪ লাখ স্থায়ী চাকরির সমান। আর ২০৩০ সালে তা হবে; ৩৮.৩৩ লাখ স্থায়ী চাকরির সমান। অর্থাৎ, শ্রমঘণ্টা হারানোর এ হার আলোচ্য সময়ে প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়বে।

গত বছরের আইএলও প্রতিবেদনে, তাপপ্রবাহে বিশ্বজুড়ে ৮ কোটি স্থায়ী চাকরির সমান শ্রম সম্ভাবনা হারাবে বলে জানানো হয়।

এ অবস্থায় ম্যাককিনসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, বিশ্ব যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে না পারে, তবে সমগ্র এশিয়াতে গড়ে দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়বে। আর ঘন ঘন দেখা দেওয়া তাপপ্রবাহ জনিত অবসাদে; বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের ৫০ থেকে ৭০ কোটি জনসংখ্যা ব্যাপকহারে প্রভাবিত হবে। কিছু কিছু স্থানে তাপপ্রবাহে মানুষের জন্য টিকে থাকা বা বসবাস করাটা হয়ে পড়বে প্রায় অসম্ভব।

প্রতিবেদনটি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু উন্নত দেশের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে অবহেলা; দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-ধারণ এবং জীবিকার জন্য যে সমূহ ক্ষতির কারণ হবে-সেদিকেও আলোকপাত করেছে।

ম্যাককিনসের মতে, বিস্তীর্ণ ক্ষতির এ সম্ভাবনা বর্তমান মহামারির সময়ে এ অঞ্চলে দেখা দেওয়া মন্দা পরিস্থিতির সমান নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

”আশা হারিয়ে ফেলা উচিৎ হবে না। আমরা দেখেছি কিছু কিছু দেশ, শহর বা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ফলপ্রসূ পদক্ষপে নিতে পারেন জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসে। এখন সকলকেই সেদিক থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি এসব পদক্ষেপ টেকসইভাবে বাস্তবায়িত করতে পারি এবং তা নিয়ে যদি বৈশ্বিক সহযোগিতার কলেবর বৃদ্ধি পায়; তাহলে অবশ্যই সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ফল পাওয়া সম্ভব হবে” বলছিলেন ম্যাককিনসের এশিয়া শাখার চেয়ারম্যান এবং আলোচ্য প্রতিবেদনের সহ-লেখক অলিভার টনবি।

নোয়ার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ইতোপূর্বে প্রকাশিত নানা সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিপর্যয়ের তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সমুদ্রতত্ত্ব এবং বায়ুমণ্ডল (গবেষণা) প্রশাসন- নোয়া।

চলতি সপ্তাহেই প্রকাশিত মার্কিন সংস্থার প্রতিবেদনটি বিগত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হালচাল তুলে ধরে। আগামীতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অব্যাহত হুমকিকে যা আরো স্বচ্ছ করে তুলে ধরছে।

২০১৯ সালের তাপচিত্রের আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে; এবছর অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ ক্ষরার দরুণ ভয়াবহ দাবানল সৃষ্টি হয়েছিল। দাবানলে অর্ধশত কোটি বন্যপ্রাণি এবং গাছের শোচনীয় মৃত্যুর কথা জানা যায় পরবর্তী সময়ে। অবশ্য, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের প্রকাশিত এক সংবাদে অস্ট্রেলীয় এক জীববিজ্ঞানীর বরাতে শত কোটি প্রাণির মৃত্যুর অনুমানও জানিয়েছিল।

গত বছর দীর্ঘ তাপদাহে দগ্ধ হয়- ইউরোপ, জাপান, পাকিস্তান এবং ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মহাসমুদ্রের পানির উপরিভাগে উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে একশ’র কাছাকাছি সাইক্লোন তাণ্ডব চালায় উষ্ণমণ্ডলীয় ভূভাগে। নোয়া জানায়, এ সময়ে তারা উত্তর এবং দক্ষিণ দুই মেরুতেই হিমবাহ গলে যাওয়ার মারাত্মক গতি লক্ষ্য করেছে। রেকর্ড করেছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষরা ও বন্যায়; ফসল এবং অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।

বিজ্ঞানীরা জানান, ২০১৯ সালে টানা কয়েক মাস জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পর গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ আবরণ থেকে ১৯ হাজার ৭শ’ কোটি টন বরফ গলে যায়। এ পরিমাণ বরফের পানিতে ৮ কোটি অলিম্পিক মানের সুইমিং পুল ভর্তি করা সম্ভব।

উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বায়ুদূষণের ফলে তৈরি তাপমাত্রা শোষণকারী গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ এসময় বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। এসময় কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রোজ অক্সাইডের পরিমাণ ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বাড়ে। এভাবেই জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষুধা আমাদের গ্রহকেই বসবাসের অনুপযুক্ত করছে।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আসলে দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ বিরোধী উদ্যোগে অর্থনীতি ক্ষতি এড়াতে পারবে না। তাই সবুজ অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন (আঙ্কটাড) ও নানা সংস্থা।

 

  • 28
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে