সুরক্ষা লকডাউনেই

প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২০; সময়: ১১:১১ পূর্বাহ্ণ |
সুরক্ষা লকডাউনেই

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর দিকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছিল। ইউরোপের সংক্রমিত ইতালি, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ থেকে মার্চের শুরুর দিকে প্রায় এক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি ফিরে এসেছিলেন। দেশে ৮ মার্চ প্রথম তিনজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে গিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ জনে পৌঁছায়। তাদের আটজনই ছিলেন শিবচরের বাসিন্দা। শিবচরে ইতালি ফেরত একজনের শরীরে ১৩ মার্চ করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তার সংস্পর্শে থাকা পরিবারের আরও দু’জন সংক্রমিত হন। এরপর ধাপে ধাপে ওই উপজেলার আরও ৫ জন আক্রান্ত হন। এরপর ১৯ মার্চ দেশের প্রথম এলাকা হিসেবে শিবচরকে লকডাউন ঘোষণা করে প্রশাসন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এই শিবচরে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ২৪ জন।

শিবচরের মতো রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগও শুরুতে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। গত ২১ ও ২২ মার্চ পরপর দু’দিনে এই এলাকায় করোনা আক্রান্ত দু’জনের মৃত্যু হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে আক্রান্ত ৩০ জনের ৯ জনই ছিলেন টোলারবাগের বাসিন্দা। ২৩ মার্চ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) টোলারবাগ এলাকাকে হটস্পট হিসেবে ঘোষণা করে। এলাকাটিকে লকডাউন ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন। রাজধানীতে এটিই প্রথম লকডাউন করা এলাকা। গত সোমবার পর্যন্ত এই এলাকায় মাত্র ১৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের সবাই সুস্থও হয়ে উঠেছেন। নতুন করে কোনো সংক্রমণ নেই।

শিবচরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সারাদেশে যখন ১৭ জন আক্রান্ত ছিলেন, তখন শিবচরে ছিলেন আটজন। ইতালি ফেরত একজনের মাধ্যমে সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। পরে আরও সাতজন আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ব্যক্তিরাও ছিলেন। এর পরই লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এই লকডাউনের মাধ্যমে এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতে কিংবা বের হতে দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করাও সম্ভব হয়েছে।

আইইডিসিআরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, শিবচর এবং টোলারবাগ সারাদেশের জন্য আদর্শ হতে পারে। সংক্রমণের শুরুতেই আইইডিসিআরের পরামর্শ মেনে প্রশাসন এলাকা দুটিকে কার্যকরভাবে লকডাউন করে। লকডাউন করে যে সুফল পাওয়া যায়, তার প্রকৃত উদাহরণ এই দুটি এলাকা। গত কয়েকদিন ধরে সেখানে নতুন করে কোনো সংক্রমণ নেই। সংক্রমিতদের সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এই দুটি এলাকাকে আদর্শ ধরে সারাদেশে তা অনুসরণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব জেলা-উপজেলায় এখনও আক্রান্ত পাওয়া যায়নি কিংবা সংখ্যায় কম, সেসব এলাকায় কার্যকর লকডাউন করতে পারলে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, আমাদের দেশে কখনোই কার্যকর লকডাউন হয়নি। কয়েকদিন আগে গার্মেন্টের পাশাপাশি ঈদ সামনে রেখে দোকানপাটও খুলে দেওয়া হলো। কার পরামর্শে এমনটি করা হয়েছে জানা নেই। সর্বোচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। কম আক্রান্ত জেলাগুলোতে এখনও কার্যকর লকডাউন করতে পারলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

৪০ জেলায় আক্রান্ত ৫০-এর কম :মানিকগঞ্জের সিংগাইরে প্রথম ৫ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত এই জেলায় ২৯ জন আক্রান্ত হয়েছে। রাজবাড়ীর পাংশায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১৬ এপ্রিল। এ পর্যন্ত এ জেলায় ২৩ জন শনাক্ত হয়েছে। ১৩ এপ্রিল ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত শনাক্ত ৩২ জন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৭ এপ্রিল। সেখানেও এ পর্যন্ত ৩২ জন আক্রান্ত। ২৯ এপ্রিল খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৩ জন। ১৬ এপ্রিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত শনাক্ত ৫ জন। রাঙামাটিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ৬ মে। এরপর নতুন করে কেউ আক্রান্ত হয়নি। ১৭ এপ্রিল ফেনীর ছাগলনাইয়ায় এক ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত ১৩ জন শনাক্ত হয়েছে। ৫ এপ্রিল মৌলভীবাজারে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর এ পর্যন্ত শনাক্ত ৩৬ জন। সিলেটে ৩৯ জন শনাক্ত হয়েছে। এই জেলায় ৫ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১২ এপ্রিল সুনামগঞ্জে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত ৪৩ জন শনাক্ত হয়েছে। ২৩ এপ্রিল গাইবান্ধায় প্রথম ২ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। তারা যুক্তরাষ্ট্র ফেরত। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ২৫ জন। ১৩ এপ্রিল নীলফামারীতে প্রথম চারজন করোনায় আক্রান্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৪৩ জন। ১১ এপ্রিল লালমনিরহাটে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৫ জন। ১৩ এপ্রিল কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৬ জন। ১৪ এপ্রিল দিনাজপুরে প্রথম ৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৪৩ জন। ১৭ এপ্রিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ১০ জন। ১১ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ে তিনজনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৪ জন।

১৩ এপ্রিল খুলনায় প্রথম একজনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তিনি তাবলিগ জামাতে অংশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এ পর্যন্ত সেখানে আক্রান্ত ২২ জন। ১৫ এপ্রিল বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় একজনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫ জন। ১৩ এপ্রিল নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৪ জন। ২২ এপ্রিল মাগুরা সদর উপজেলায় একজনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৪ জন। মেহেরপুরে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন ২২ এপ্রিল। তিনি ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নমুনা সংগ্রহের কাজে যুক্ত ছিলেন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫ জন। ৩০ এপ্রিল সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় এক ব্যক্তির সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ৪ জন। ২৫ এপ্রিল ঝিনাইদহে প্রথম করোনা আক্রান্ত দুই ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৪১ জন। ২২ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় প্রথম দু’জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তাদের একজন মাদারীপুরে একটি ব্যাংকের শাখায় কর্মরত ছিলেন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৩ জন। ১৯ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। তিনি ইতালিফেরত। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩০ জন। ৫ এপ্রিল শেরপুরে ২ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৯ জন। ১০ এপ্রিল বরগুনার আমতলীতে প্রথম ২ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৭ জন। ২৪ এপ্রিল ভোলায় দু’জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১০ জন। ৯ এপ্রিল পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৯ জন। ১৪ এপ্রিল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৭ জন। ঝালকাঠিতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ১১ এপ্রিল। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৩ জন। ১৬ এপ্রিল পাবনায় প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৮ জন। ২০ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৫ জন। ১৬ এপ্রিল বগুড়ায় একজনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তিনি পুলিশ সদস্য এবং ঢাকাফেরত। সেখানে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৮ জন। ২৯ এপ্রিল নাটোরে ৮ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১৩ জন। ২০ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৬ জন। ১২ এপ্রিল রাজশাহীর পুঠিয়ায় প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৭ জন।

আক্রান্ত ১০০ জনের কম ১২ জেলায় :১৩ মার্চ মাদারীপুরের শিবচরে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। তিনি ইতালিফেরত। সেখানে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫৭ জন। ১১ এপ্রিল নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায় ইতালি প্রবাসী এক ব্যক্তির প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। সেখানে এ পর্যন্ত ৫৯ জন শনাক্ত হয়েছেন। ১৩ এপ্রিল শরীয়তপুরে প্রথম দু’জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৬০ জন। গোপালগঞ্জে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন ৯ এপ্রিল। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৬২ জন। ১০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫৮ জন। ১২ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৭৪ জন। চাঁদপুরের মতলবে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন ১০ এপ্রিল। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫৬ জন। ১১ এপ্রিল হবিগঞ্জে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৭৪ জন। ১২ এপ্রিল যশোরে এক ব্যক্তির শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৮১ জন। নেত্রকোনায় প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ১০ এপ্রিল। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৮১ জন। ১৭ এপ্রিল জয়পুরহাটে প্রথম দু’জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫৫ জন। ১২ এপ্রিল বরিশালে দু’জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৫৬ জন।

করোনা প্রতিরোধে সরকার গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, সংক্রমিত জেলাগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, কার্যকর লকডাউন যেখানে হয়েছে, সেখানে সংক্রমণও কম। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের এই সময়ে লকডাউন শিথিল করলেই বিপদ বাড়বে। শিবচর ও টোলারবাগে কার্যকর লকডাউন হয়েছিল বলে সেখানে সংক্রমণ বাড়েনি। সর্বত্রই এই পদ্ধতি অবলম্বনের তাগিদ দেন তিনি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে