মাঙ্কিপক্স নিয়ে ‘ভয় নেই’ বাংলাদেশের

প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২২; সময়: ১১:৩৮ অপরাহ্ণ |
মাঙ্কিপক্স নিয়ে ‘ভয় নেই’ বাংলাদেশের

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় মানুষ যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই নতুন ‘আতঙ্ক’ হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে আফ্রিকান ভাইরাস মাঙ্কিপক্সের। এরইমধ্যে পৃথিবীর ১৮টি দেশে দেড় শতাধিক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সে কেউ আক্রান্ত না হলেও সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশের সব বন্দরে দেওয়া হয়েছে সতর্কবার্তা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স নিয়ে এখনও বাংলাদেশের ভয়ের কোনো কারণ নেই। এছাড়া করোনাভাইরাসের মতো এটি এতোটা সংক্রামকও নয়। তাই এই ভাইরাস নিয়ে এতোটা উদ্বিগ্ন না হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্কতার পরামর্শ তাদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স আসবে কি না এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এজন্য আমাদের কিছু বিষয় বুঝতে হবে, এর মধ্যে একটি হলো উৎস। এক্ষেত্রে মাঙ্কিপক্সের প্রধান উৎস হলো মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে এটি এনডেমিক ডিজিজ। আর দ্বিতীয়ত এই রোগের উৎস হলো, ইদানিং ১২/১৪টি দেশে এই রোগে আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে সে দেশগুলোতে কিন্তু এখনও প্রমাণিত হয়নি যে রোগটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। তার মানে আমাদের দেশে রোগটি আসার ক্ষেত্রে আমরা ধরতে পারি, মূল সোর্স হলো পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা।

তিনি বলেন, আফ্রিকার এসব দেশ থেকে যদি রোগটির বাংলাদেশে আসতে হয়, আসতে হবে ব্যক্তির মাধ্যমে। সেটি হতে পারে বাংলাদেশি কেউ যদি ওখানে থাকেন এবং এই সময়ে দেশে আসেন, তাহলে তার মাধ্যমে ভাইরাসটি আসতে পারে। এর বাইরে যদি আফ্রিকার কোনো নাগরিক বাংলাদেশে আসে, তার মাধ্যমেও ভাইরাসটি আসতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের খুব বেশি লোক যে আফ্রিকায় থাকে সেটি বলা যাবে না, এমনকি বাংলাদেশেও যে ওইদেশের লোকজন বেশি আসে তাও না। তারমানে এই দাঁড়ায় যে, ভাইরাসটি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা খুব বেশি নেই। এরপরও আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে নিজেদের অবস্থান থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

বিশিষ্ট এই সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের দেশে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। সেগুলোতে নজরদারি বাড়িয়ে আমরা যদি আক্রান্ত কোনো রোগীকে বিমানবন্দরেই শনাক্ত করতে পারি, সেক্ষেত্রে তাকে নিয়ে একটি হাসপাতালে আইসোলেটেড করে চিকিৎসা দিতে পারি। তাহলে ভাইরাসটি অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারবে না।

ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, তারপরও কোনোভাবে যদি দু’চারটা কেস চলেও আসে, আমরা যদি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি, তাহলে ভাইরাসটিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার সক্ষমতা আমরা রাখি। বাংলাদেশে এখনো এই রোগের কোনো রোগী ধরা পড়েনি। বিএসএমএমইউ-তেও এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।

প্রবেশ পথে যদি রোগটি শনাক্ত করা না যায়, সেক্ষেত্রে পরে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এবং করণীয় কী হবে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, অবশ্যই এমনটি হতে পারে। কারণ, বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষ আসে, এক্ষেত্রে আমাদেরও তো এতো বেশি সক্ষমতা নেই।

তবে কেউ যদি বিমানবন্দরে শনাক্তের বাইরে থেকে যায়, তাহলে তাকে শনাক্ত করা খুব বেশি কঠিন হবে না। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তি দেশের যে প্রান্তেই যাক তাকে অবশ্যই চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর তখনই ওই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে আইসোলেটেড করতে হবে।

একইসঙ্গে নমুনা সংগ্রহের জন্য আইইডিসিআরকে জানাতে হবে। আমাদের দেশে বছরে যে সংখ্যক মানুষের চিকেনপক্স হয়, সে সংখ্যক মাঙ্কিপক্স রোগীও আফ্রিকাতে শনাক্ত হয় না। আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে কঙ্গোতে এ রোগটি একটু বেশি হয়। দেখা গেছে, সেখানে এ বছর এক হাজার তিনশ জনের মতো রোগী শনাক্ত হয়েছে।

এছাড়া বাকি অঞ্চলগুলোতে ৪০ থেকে ৫০টি করে কেস দেখা গেছে। আফ্রিকার বাইরেও মাঙ্কিপক্সের খবর আসছে, যেগুলো এর আগেও হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশগুলোতে যেসব আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে, সেগুলোর মূল সোর্সটা এখনও আইডেন্টিফাই করা যায়নি, এটি একটি উদ্বেগের বিষয়।

রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক আরও বলেন, প্লেনে আসা কোনো রোগী যদি বিমানবন্দরে শনাক্তের বাইরে থেকে যায়, তাহলে সে উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে হলেও শনাক্ত হবেই। কারণ এই রোগের যে লক্ষণ রয়েছে, সেগুলো অনেকটাই ভয়াবহ। সারা শরীরে চিকেন পক্সের চেয়েও বড় আকারের ফোসকা পড়বে। এর আগে দুইদিন তীব্র জ্বর আর শরীর ব্যথা থাকবে। তারমানে রোগের লক্ষণ দেখে রোগী ভয় পেয়ে এমনিতেই চিকিৎসকের কাছে যাবে। এজন্য উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও যাবতীয় দিক-নির্দেশনাসহ অন্তত একজন চিকিৎসককে রোগটি নিয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই মঙ্কিপক্স ভাইরাসটি আলোচনায় এসেছে, এজন্য মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা একটু বেশি কাজ করছে। তাছাড়া ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে হ-য-ব-র-ল চিত্র সাধারণ মানুষ দেখেছে, এজন্য সবাই অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে এটাকে পরিমাপ করছে। কিন্তু মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি সরাসরি একজন থেকে আরেকজনের সংস্পর্শ ছাড়া ছড়ায় না।

মাঙ্কিপক্সের ল্যাবরেটরির ডায়াগনিস নিয়ে সারা বিশ্বে একটা টানাপড়েন আছে। কারণ, মাঙ্কিপক্স বিশ্বের বহু দেশে নেই। তবে, আমাদের এখন যে সক্ষমতা, তা দিয়ে আমরা পক্স নির্ণয় করতে পারব। একইসঙ্গে যদি আমরা সিকোয়েন্সিংটাও করে ফেলতে পারি, তবে আমরা ডায়াগনসিস করতে সক্ষম হব।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে বছরে যে সংখ্যক মানুষের চিকেনপক্স হয়, সে সংখ্যক মাঙ্কিপক্স রোগীও আফ্রিকাতে শনাক্ত হয় না। আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে কঙ্গোতে এ রোগটি একটু বেশি হয়। দেখা গেছে, সেখানে এ বছর এক হাজার তিনশ জনের মতো রোগী শনাক্ত হয়েছে।

এছাড়া বাকি অঞ্চলগুলোতে ৪০ থেকে ৫০টি করে কেস দেখা গেছে। আফ্রিকার বাইরেও মাঙ্কিপক্সের খবর আসছে, যেগুলো এর আগেও হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশগুলোতে যেসব আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে, সেগুলোর মূল সোর্সটা এখনও আইডেন্টিফাই করা যায়নি, এটি একটি উদ্বেগের বিষয়।

ডা. আলমগীর বলেন, আমাদের এ অঞ্চলে বা ইউরোপে এই ভাইরাসটি তেমন একটা দেখা যায় না। কিন্তু এবার ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানিসহ তিনটি মহাদেশে এর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। তবে করোনা বা অন্য ভাইরাসের তুলনায় এর ছড়িয়ে পড়ার গতি কিন্তু প্রবল নয়। যেহেতু বিশ্বের কয়েকটি দেশে একযোগে শনাক্ত হচ্ছে, তাতেই শঙ্কাটা বেড়েছে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, মাঙ্কিপক্স নিয়ে বাংলাদেশের ঝুঁকি কম, যেটিকে আমি বলি দূরবর্তী ঝুঁকি। আফ্রিকাতে এই ভাইরাসটি ছড়ায় ইঁদুর, কাঠবিড়ালি বা এ জাতীয় প্রাণী থেকে। আবার অনেকেই দেখি বলে বেড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স মাঙ্কি (বানর) থেকে ছড়ায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ভাইরাসটি বানর থেকে আসে না।

তবে সর্বপ্রথম বানরের শরীর থেকেই ভাইরাসটির উৎপত্তি হয় ৬৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে। এরপর ১৯৭০ সালে কঙ্গোতে প্রথম মানুষের দেহে সংক্রমণ ছাড়ায়। তারপর থেকে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষের মধ্যে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়েছে। যা এখন আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে এতোটা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে আসারও তেমন একটা সম্ভাবনা নেই। তবে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। এই ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রস্তুত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আফ্রিকাতে দুই ধরনের মাঙ্কিপক্স পাওয়া যায়। কঙ্গোতে যে ভাইরাস পাওয়া যায়, তার মৃত্যুর হার ১ থেকে ১০ শতাংশ। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার ভাইরাসে মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য বলা চলে। এবার এখনো এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মাঙ্কিপক্স শনাক্তে আইইডিসিআরের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ এস এম আলমগীর বলেন, মাঙ্কিপক্সের ল্যাবরেটরির ডায়াগনিস নিয়ে সারা বিশ্বে একটা টানাপড়েন আছে। কারণ, মাঙ্কিপক্স বিশ্বের বহু দেশে নেই। তবে, আমাদের এখন যে সক্ষমতা, তা দিয়ে আমরা পক্স নির্ণয় করতে পারব। একইসঙ্গে যদি আমরা সিকোয়েন্সিংটাও করে ফেলতে পারি, তবে আমরা ডায়াগনসিস করতে সক্ষম হব।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে