অ্যালঝেইমারস আক্রান্তের শীর্ষে রাজশাহী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১; সময়: ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ |
অ্যালঝেইমারস আক্রান্তের শীর্ষে রাজশাহী

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : পরিবারের প্রিয়জন কিংবা প্রতিবেশী কোনো বয়স্ক মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথ ভুলে যাচ্ছেন। বাড়ি ফিরে আসতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। অতি পরিচিতজনকেও চিনতে পারছেন না। কথা বলতে গিয়েও মাঝেমধ্যে আটকে যাচ্ছে। মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই।

এ ধরনের স্মৃতিলোপ পাওয়া ব্যক্তির বয়স যদি পঁয়ষট্টি অতিক্রম করে থাকে এবং সমস্যাটি যদি ঘনঘন অনুভূত হয়, তাহলে বুঝতে হবে তিনি আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী শূন্য দশমিক ১ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। ওয়ার্ল্ড আলঝেইমারস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বিশ্বে ৫০ মিলিয়নের বেশি মানুষ আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত। ২০৫০ সাল নাগাদ এটি ১৫ কোটি ছাড়াবে।

এ ছাড়া প্রতি সেকেন্ডে নতুন করে ৬৮ জন এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সী প্রতি নয়জনে একজন করে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ‘ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জানুন, আলঝেইমারস সম্পর্কে জানুন’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব আলঝেইমারস দিবস।

বাংলাদেশে আলঝেইমারস

বাংলাদেশে এ রোগের বিস্তার জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও আইসিডিডিআর, বি এক যৌথ গবেষণা পরিচালনা করে। দেশের আটটি বিভাগের দুই হাজার ৭৯৬ মানুষের ওপর এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এদের দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামীণ এলাকায় এবং এক-তৃতীয়াংশ নগর এলাকার বাসিন্দা।

নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সেলিম শাহী বলেন, এ গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ বছরের ওপরের বয়সী মানুষের মধ্যে ৮ দশমিক ১ শতাংশ আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। তবে যেসব এলাকায় বেশি মানুষকে যুক্ত করা হয়েছে, সেসব স্থানে বেশি রোগী পাওয়া গেছে। এ কারণে এলাকাভেদে সংখ্যাগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগী রাজশাহী বিভাগের বাসিন্দা। এরপর পর্যায়ক্রমে রংপুরে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, খুলনায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, বরিশালে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, সিলেটে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ঢাকায় সবচেয়ে কম ২ দশমিক ৯ শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে।

অন্য কী কী রোগ থাকলে আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় আশঙ্কা তৈরি হয়, জানতে চাইলে ডা. সেলিম শাহী বলেন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে, লিভার ও কিডনি সমস্যা, থাইরয়েড ও হরমোনাল সমস্যা থাকলে সেই ব্যক্তির আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকবে। সুতরাং এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা নিতে হবে। একই সঙ্গে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ দেশে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৫ শতাংশ, ৭৫ বা তার বেশি বয়সী ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ নাগরিক আলঝেইমারস রোগে ভুগছেন। তবে ঝামেলামুক্ত স্নায়ুকোষ ১০০ থেকে ১২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু খুব কমসংখ্যক স্নায়ুকোষই এত বছর বেঁচে থাকতে পারে।

ঝুঁকিতে আছেন কারা

আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়া নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে কাজ করছে ডিমেনশিয়া কেয়ার ফাউন্ডেশন। জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি। নিউরোলজি ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।

সংস্থার মহাসচিব রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, পারকিনসনসহ অন্তত একশ রোগ এই আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী। বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এই দুটি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

কেন হয় আলঝেইমারস

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিস্কের কোষ বা নিউরনগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। ফলে স্মৃতিলোপ পায়। আলঝেইমারস বা ডিমেনশিয়ার বিশেষত্ব হলো ভুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। মস্তিস্কের সামনের অংশ ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে।

আলঝেইমারস রোগে এই অংশের ক্ষতি হয়। ফলে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। পঁয়ষট্টি বছরের পর থেকেই অনেকে আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত হন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৮০ বছরের পর থেকে মস্তিস্কে ছোট ছোট স্ট্রোকের ফলে কোষ শুকিয়ে যেতে থাকে; তখন এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুকোষ নিউরনের ভেতর কিছু মুক্ত মৌলিক ধাতু জমতে থাকে। এই ফ্রি রেডিক্যালই নিউরন ক্ষতের অন্যতম কারণ। শরীরের ভেতর প্রতিকূল অবস্থায় ক্রটিপূর্ণ বায়োলজিক্যাল অক্সিডেশনের কারণে ফ্রি রেডিক্যাল সৃষ্টি হয়। এই ফ্রি রেডিক্যাল স্নায়ুকোষের পুরো আয়ুস্কাল নষ্ট করে দেয়। ফলে মস্তিস্কে নানা ধরনের কাজে বাধার সৃষ্টি হয়।

ডা. মোহিত কামাল বলেন, কোলাজেন ও ডিএনএ মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রোটিন। জীবনের জন্য অপরিহার্য এসব অণুর আড়াআড়ি সংযোগের কারণেও নিউরনগুলোর ক্ষতি হয়। এ ছাড়া কোষের মেটাবলিজমের পর সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থগুলো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জমাট বাঁধতে শুরু করে। এই জমাট বাঁধার পরিমাণ যত বেশি হয়, কোষের তত বেশি ক্ষতি হয়। এতে স্মৃতিলোপ পায়।

প্রতিকারের উপায়

কীভাবে আলঝেইমারস প্রতিরোধ করা যায়- সে সম্পর্কে জানতে চাইলে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবার, মলমূত্র ত্যাগ ইত্যাদির ওপর নজর রাখতে হবে।

এ সময় পুষ্টি বজায় রাখা খুব জরুরি। বিষাদে আক্রান্ত হলে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট এবং ভিটামিনের প্রয়োজন হয়। অ্যাসিটাইলকোলিন নিঃসরণ বাড়ানোর জন্য কোলিনার্জিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার মান উন্নত করা গেলেও রোগের চলমান ক্ষয়রোধ করা সম্ভব হয় না।

আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজির জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলঝেইমারস প্রতিরোধে মাছের তেল বিশেষ উপাদেয়। কারণ মাছের তেল মানুষের স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিস্কের আকার বাড়ায়। অন্য এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মাছের তেলে উচ্চমাত্রার ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা মস্তিস্কের আকার বৃদ্ধি করে। বয়স্কদের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

ত্রিশ বছর ধরে একজন নিউরোলজিস্ট হিসেবে রোগীদের চিকিৎসা করে আসছেন জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম। তিনি জানান, শুরুর দিকে যত আলঝেইমারস রোগী পেতেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে তার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ রোগী বেশি পাচ্ছেন। এর পরও রোগটি নিয়ে সচেতনতামূলক তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। এ কারণে রোগটির ভয়াবহতা ও প্রতিকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে তেমন ধারণা তৈরি হয়নি। আলঝেইমারস রোগটির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ডা. বদরুল আলম বলেন, বিশেষ করে ৪০ বছরের পর থেকেই মস্তিস্কের ক্ষয় শুরু হয়। ক্ষয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিস্কের পুরুত্ব কমে তা সংকুচিত হয়। সেরিব্রাল সালকাইগুলো চওড়া হয়ে যায়। ফলে বিকল্প মস্তিস্কের নিলয়ের আকার বাড়তে থাকে। নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর নিঃসরণের মাত্রা কমতে থাকে। এর মধ্যে একটি অ্যাসিটাইলকোলিন। এটির মাত্রা কমতে থাকে।

ফলে স্নায়ুকোষের সংকেত সঞ্চালন ক্ষমতা কমে। অনুভূতি ও চিন্তাচেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থায় স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। জিনগত রোগী ছাড়া কেউ এ রোগে আক্রান্ত হলে তা চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। জিনগত রোগীদের চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বলে জানান তিনি। সূত্র- সমকাল

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে