সংক্রমণের তীব্রতার মধ্যেই সংকটে বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা উৎপাদক দেশ
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহ প্রকোপের মধ্যেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ ভারতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন লাখ লাখ মানুষ।
সারা বিশ্বে এখনো পর্যন্ত বিক্রিত ভ্যাকসিনের ৬০ শতাংশই উৎপাদন হয় ভারতে এবং দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (এসআইআই) বিশ্বের বৃহতম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক। নিজেদের বিশাল উৎপাদন ক্ষমতার কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে সরবরাহকারী হিসেবে সেরামকে যুক্ত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভ্যাক্স শুরু করে ৯২টি স্বল্প আয়ের দেশে সুলভ ও ছাড়কৃত মূল্যে টিকার ডোজ সরবরাহের লক্ষ্যে, আর সেজন্যই ভারত ও সেরাম পায় প্রধান সরবরাহ উৎসের গুরুত্ব। সেরামের সঙ্গে চুক্তির আওতায় প্রাথমিকভাবে সংস্থাটির ২০ কোটি ডোজ সরবরাহের কথাও ছিল।
কিন্তু, তাতে বাধ সাধে ভারতে পরিবর্তিত করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। মার্চ থেকে শুরু হওয়া সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ প্রথমটির চাইতেও মারাত্মক রূপ নিয়েছে। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে যেখানে সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ রেকর্ড করা হয় ৯৭ হাজারের বেশি, সেই সংখ্যাই আজ রোববার (১৮ এপ্রিল) নাগাদ ২৬১,৫০০ জনকে আক্রান্ত করেছে বলে জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যেই নতুন করে আরো ১০ লাখ জনের সংক্রমণ ধরা পড়ার কারণে গেল বৃহস্পতিবারই ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
ভারতের বিভিন্ন শহরে নতুন করে নানা বিধিমালা ও নিয়মকানুন আরোপ করার পাশাপাশি ১৯ মিলিয়ন মানুষের বাসস্থান দিল্লীতে রাতের বেলা কারফিউও জারি করা হয়েছে। লকডাউন বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় অভিবাসী শ্রমিকেরাও শহর ছেড়ে নিজেদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও প্রধান প্রধান শহরের কর্তৃপক্ষ নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করছেন জন-সমাগম ও চলাচলে, প্রায় দুই কোটি অধিবাসীর নগরী রাজধানী দিল্লিতে জারি হয়েছে নৈশকালীন কারফিউ। আবারও শহর ছেড়ে গ্রামে নিজ বাড়ি মুখো হচ্ছেন দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিক। সম্ভাব্য লকডাউন চালু হলে আটকা পড়বেন এই ভয়েই তারা যেন শহর ছেড়ে পালাচ্ছেন।
এসব ঘটনার মধ্যেই মাঠ পর্যায়ে শূন্যের কোঠায় টিকার ডোজ সরবরাহ, অন্তত ৫ টি রাজ্য তাদের চরম ভ্যাকসিন সংকটের কথা জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
সংকট নিরসনে এখন সেরাম এবং ভারত সরকার কোভ্যাক্স প্রোগ্রাম থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আগে নিজ দেশের নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেওয়ার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট ‘গ্যাভি’ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মিলিতভাবে চালানো কোভ্যাক্স প্রোগ্রাম জানিয়েছে, “মার্চ ও এপ্রিলে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন ডোজ পেতে দেরি হবে। ভারতের নিজস্ব চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াই এই দেরির কারণ।”
সেরাম উৎপাদিত ও কোভ্যাক্সের সরবরাহ করা ভ্যাকসিনের চালান গত ১৫ মার্চ সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে পৌঁছায়। ছবি: সিএনএন
এপর্যন্ত ভারত ২৮ মিলিয়ন ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন কোভ্যাক্স- এ সরবরাহ করেছে এবং মার্চে আরো ৪ কোটি ও এপ্রিলে ৫ কোটি ডোজ দেয়ার কথা ছিল। বিজ্ঞপ্তিতে কোভ্যাক্স আরো জানায়, তারা ভারত সরকারের সঙ্গে সরবরাহ চুক্তি পূরণের ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কোভ্যাক্স প্রোগ্রামে ভারতের ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ করা এবারই প্রথম নয়। জানুয়ারিতেও সরকার সেরাম উৎপাদিত
অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছিল। সেরামের মুখ্য নির্বাহী আদর পুনেওয়াল্লা জানান, “এর কারণ সরকার সবচেয়ে দুর্বল ও যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদেরই আগে ভ্যাকসিন দিতে চেয়েছিল।”
কিন্তু, ভ্যাকসিন সরবরাহে ভারতের এই পুনঃপুনঃ দেরির ফলে দরিদ্র দেশগুলোতে সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। আফ্রিকার রোগ নিরাময় পরিষদ সতর্ক করেছে যে, ভারতের এই দেরি তাদের মহাদেশের জন্য ‘দুর্যোগময়’ হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তান এই শূন্যতা পূরণে বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
টিকাদান কেন্দ্র থেকে ফিরে যাচ্ছে সাধারণ জনগণ:
এই মুহূর্তে ভারত দেশীয় পর্যায়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা (কোভিশিল্ড নামেও পরিচিত) এবং ভারত বায়োটেক ও সরকার নিয়ন্ত্রিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) সঙ্গে মিলিতভাবে প্রস্তুতকৃত ‘কোভ্যাক্সিন’ নামক দুটি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে কোভিড-১৯ টিকা কর্মসূচি চলছে।
জানুয়ারিতে স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিতে থাকা প্রাধান্য পাওয়ার উপযুক্ত শ্রেণির মধ্যে প্রথমে দিয়ে দেশটির জাতীয় টিকা কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম পর্যায়েই ৩০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নেয় সরকার। কিন্তু, স্বেচ্ছাসেবী স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং জনসাধারণের মধ্যে ভ্যাকসিন বিষয়ে অবিশ্বাস থাকার ফলে শুরুর দিকে এই প্রকল্পের গতি ছিল মন্থর। বিশেষ করে ‘কোভ্যাক্সিন’ টিকাটিকে তৃতীয় পর্যায়ের মানব ট্রায়ালে কার্যকারিতার ডেটা পাওয়ার আগেই জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ায় এর উপর মানুষের নির্ভরতা ছিল না।
এপর্যন্ত মাত্র ১৪ লাখ ৩০ হাজার ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বা দুই ডোজ টিকা নিয়েছে, যা ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ বলে জানিয়েছে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু, সরকারি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনসহ নানা প্রচারণার ফলে জনসাধারনের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাস জন্ম নেয় এবং টিকাদান কর্মসূচি গতি ফিরে পায়। জনগণ যখন টিকা নিতে উৎসাহী হচ্ছিল, তখনই হানা দেয় দ্বিতীয় ঢেউ, যা প্রতিষেধকের চাহিদা আরও বাড়ায়, ফলে মার্চ ও এপ্রিলে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে থাকার কালেই কয়েকটি রাজ্যে চরম ভ্যাকসিন সংকট দেখা দিয়েছে।
গত ৯ এপ্রিল মুম্বাইয়ের একটি টিকা কেন্দ্রের চিত্র, এখানে টিকা নিতে আসা সকলকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি: সিএনএন
উড়িষ্যায় গত সপ্তাহে ভ্যাকসিনের অভাবে প্রায় ৭০০টি টিকাদান কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যের এ অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে।
আরেক রাজ্য পাঞ্জাবের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রাজেশ ভাস্কর মার্কিন বার্তা সংস্থা- সিএনএনকে জানান, গত সপ্তাহে রাজ্যে মাত্র সাড়ে চার লাখ কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিনের ৩০ হাজার ডোজ অবশিষ্ট ছিল। সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাঞ্জাবের জনসংখ্যা ২ কোটি ৭০ লাখ মিলিয়ন। রাজেশ জানালেন, তারা প্রতিদিন এক লাখ জনকে টিকা দিতে চাইলেও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ডোজের যোগান কম।
সবচেয়ে প্রভাবিত রাজ্য মহারাষ্ট্রের বেশকিছু জেলায়ও টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত রাখা হয়েছে বলে জানান রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপে।
গত ৭ এপ্রিল তিনি বলেন, “আমরা গ্রাম ও শহরগুলোতে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেছি, তারা ৪৫ বছরের বেশি বয়সীদের টিকা দিতে নিয়ে আসছে। কিন্তু, এখন মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আসলেও তাদেরকে বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।” উল্লেখ্য, গত সপ্তাহেই রাজ্যের প্রধান নগরী মুম্বাইয়ের অন্তত ৭০টি কেন্দ্র ডোজ স্বল্পতার কারণেই বন্ধ করা হয়। মহারাষ্ট্রেই ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ১ কোটি ১১ লাখ ব্যক্তিকে টিকা দেওয়ার কথাও জানান তিনি।
আইসিএমআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল নির্মল কুমার গাঙ্গুলী বলেন, “কাঁচামালের অভাব ভ্যাকসিন সরবরাহ কম হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদনের যথেষ্ট যোগ্যতা আছে কিন্তু মহামারির কারণে সরবরাহ প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটছে। এটা রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের কাঁচামালের জন্য বিদেশ থেকে আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়।”
এর আগে ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাঁচামাল রপ্তানির উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র । সেই সাথে ইউরোপিয় ইউনিয়নও ভ্যাকসিন রপ্তানি সম্পর্কিত বিধিনিষেধ জোরদার করেছে। তাই ভারতকে বর্তমানে নিজ দেশে থাকা কাঁচামাল বা সিঙ্গাপুরের মত দেশ থেকে আসা কাঁচামালের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে যা ভ্যাকসিন উৎপাদনকে দীর্ঘায়িত করছে।
গাঙ্গুলী আরো জানান, সেরামের উপর অতি-নির্ভরশীলতাও একটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ। ভারত বায়োটেকের মত অন্যান্য উৎপাদনকারী থাকলেও মূলত সেরামের এর উপরেই বেশি নির্ভর করা হচ্ছে।
গাঙ্গুলী মনে করেন, দেশের চাহিদাই দেখিয়ে দিয়েছে, ভারতের আরো উৎপাদন বাড়াতে হবে। কেবলমাত্র ২-৩টি কোম্পানি দ্বারা ভ্যাকসিন উৎপাদন যথেষ্ট নয়।
সরকারের মিশ্র প্রতিক্রিয়া:
ভারতের বেশকিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আরও ভ্যাকসিন ডোজ চাইলেও কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারা পাল্টা রাজ্যগুলোকেই দোষ দিচ্ছেন, ডোজের কোনো সঙ্কট নেই বলেও তারা দাবি করছেন।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রী হর্ষ বর্ধন গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেন, “আজকের এসব অভিযোগ আর কিছুই নয়, শুধু মহামারির বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র সরকারের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টা।” দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও ভ্যাকসিন সংকটের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি জানান, ভারতের কাছে নিজেদের জনগণের জন্য পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মোদি ভারতের টিকা প্রকল্পের প্রশংসা করে নিজেদের সফল বলে দাবি করেছেন।গত বুধবার রাজ্য গভর্নরদের সাথে এক বৈঠককালে, তিনি ভারতকে ১০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজ দেওয়ার মাইলফলক অর্জন করায় টিকদানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততর দেশ হিসেবে উল্লেখ করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব রাজেশ ভূষণও বলেন, “আমরা রাজ্যগুলোতে একটি সময়সীমা মেনে ভ্যাকসিন পাঠাচ্ছি। সংকটের আসল কারণ হচ্ছে অব্যবস্থাপনা। আপনি গিয়ে দেখুন কত অব্যবহৃত ভ্যাকসিন যে পরে আছে হিমাগারে।”
স্বাস্থ্য সচিবের এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজ্যগুলোর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। ১০ এপ্রিল রাজস্থানের প্রধানমন্ত্রী অশোক গেহলট তার এই বক্তব্যকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে টুইট বার্তায় লিখেন।
সবকিছু মিলে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ বাড়ছে, যেকারণে তারা এই সপ্তাহে ভ্যাকসিন আমদানি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
মডার্না বা ফাইজারের মত টিকা ভারতে রপ্তানি হবে আশা করা হলেও তা বেশ কঠিন, কারণ কোম্পানি দুটির টিকা ইতোমধ্যেই অন্যান্য দেশের চাহিদা পূরণ করছে।
14