বাড়ছে সংক্রমণ, বাড়ছে বিধিনিষেধ

প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২১; সময়: ১১:০০ অপরাহ্ণ |
বাড়ছে সংক্রমণ, বাড়ছে বিধিনিষেধ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কায় দৈনিক শনাক্ত রোগী পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় সেই সঙ্গে বাড়ছে কড়াকড়ি। গতবছরের মত সবকিছু বন্ধ করে ঘরবন্দি হওয়ার নির্দেশ এখনও না হলেও জনসমাগম কমানোর পাশাপাশি সংক্রমণে উৎস বন্ধে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে।

পর্যটন এলাকাগুলোতে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি বিদেশিদের বাংলাদেশে প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ধাক্কা যেভাবে সরকার ‘সামাল দিয়েছিল’ সেভাবেই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করতে হবে।

করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬ হাজার ৮৩০ জন আক্রান্ত হয়েছে। যা একদিনে দেশে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছে ৬ লাখ ২৪ জার ৫৯৪ জন। এছাড়া এ সময়ে নতুন করে আরও ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে দেশে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৯ হাজার ১৫৫ জনে।

শুক্রবার বিকেল স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক বিজ্ঞপ্তি থেকে দেশের করোনা পরিস্থিতির সর্বশেষ এ তথ্য জানা গেছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত একদিনে আরও ২ হাজার ৪৭৩ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত স্স্থু হয়েছেন ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪১১ জন।

এর আগের দিন বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৬ হাজার ৪৬৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গত সোমবারই দেশে প্রথমবারের মত এক দিনে পাঁচ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল। তিন দিনের মাথায় তা সাড়ে ছয় হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। দেশে এক দিনে আরও ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা একদিনে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর আগে গতবছরের ৩০ জুন ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিল, যা এক দিনের সর্বোচ্চ।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দুই মাসের ‘লকডাউনে’ জনজীবন একপ্রকার অচল ছিল। এরপর সংক্রম কমার সঙ্গে সঙ্গে বিধিনিষেধও ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে দেশে দৈনিক শনাক্তের হার নেমে এসেছিল তিন শতাংশের নিচে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে আবার সংক্রমণ আবার বাড়ছে দ্রুত গতিতে। দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৪ জনে। তাদের মধ্যে ৯ হাজার ১০৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস।

এক মাসের হিসাবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে গতবছর জুন মাসে। দেশে সংক্রমণ শুরুর চতুর্থ ওই মাসে মোট ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। এরপর কমতে কমতে ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছিল ১১ হাজার ৭৭ জনে। মার্চে তা এক ধাক্কায় ৬৫ হাজার ৭৯ জনের পৌঁছেছে।

মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি মত্যু দেখতে হয়েছে গতবছরের জুলাই মাসে। সে মাসে ১ হাজার ২৬৪ জনের মৃত্যুর পর ডিসেম্বর ছাড়া প্রতি মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছিল। ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে এসেছিল ২৮১ জনে। মার্চে আবার মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৬৩৮ জন হয়েছে। এ পর্যন্ত যারা মারা গেছেন, তাদের ৫৫.৯ শতাংশের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। আর মৃতদের ৫৭.০২ শতাংশই ছিলেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা।

প্রতিদিন রোগী বাড়তে থাকায় হিমশিম খেতে হচ্ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোকে। বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় কোভিড চিকিৎসার ১০ সরকারি হাসপাতালের ২৫১১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি আছে ২০৫টি। আর ১০৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে মাত্র ৪টি ফাঁকা আছে। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এক সপ্তাহ ধরে দৈনিক শনাক্ত রোগীর গড় হার ১০ শতাংশের বেশি, এরকম ৩১টি জেলাকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছে সরকার। জেলাগুলো হল: মৌলভীবাজার, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, নরসিংদী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশাল, রাজশাহী, বগুড়া, নড়াইল, নীলফামারী, গাজীপুর, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, মাদারীপুর, নওগাঁ, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইল ও কক্সবাজার।

দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। বুধবার ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করাতে আসা মানুষের ভিড়। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় ২৯ মার্চ সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সকল ক্ষেত্রে সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি হয়েছিল। সেগুলো বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে গত দুদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ির ঘোষণা আসছে।

এরইমধ্যে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পাশাপাশি জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠান/ শিল্প কারখানা অর্ধেক জনবল দিয়ে চালাতে বলা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার এবং কুয়াকাটার পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য বাদে পুরো ইউরোপ এবং আরও ১২টি দেশ থেকে যাত্রীদের বাংলাদেশে প্রবেশে জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

এর পাশাপাশি সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্র, বইমেলা ও অন্যান্য মেলা অবিলম্বে বন্ধ করার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রতিদিন নতুন রোগী বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলোর কোভিড ইউনিটগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে এলাকার রোগীদের সেখানেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া যায়।

করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করতে আসা মানুষ যাতে সহজে সেবা পায়, তার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে পরীক্ষার চাহিদা ‘বাড়তে পারে’ জানিয়ে সেজন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছে কমিটি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরার বিষয়ে ইতোমধ্যে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেসব যাতে পালন করা হয়, তার ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, “কিছু নির্দেশনা আমরা দিয়েছি। ধীরে ধীরে চেষ্টা করে যাচ্ছি এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। কিন্তু সেইক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতা দরকার। আজ কতজন মানুষকে হারালাম। করোনাভাইরাস সম্পর্কে যদি একটু সচেতন থাকতেন তাহলে আর হত না।”

পাশাপাশি জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “প্রত্যেককে বলব, বিয়ে শাদী কম লোক নিয়ে ঘরোয়াভাবে করাৃ যেগুলোর তারিখ হয়েছে। বাইরের লোকের সাথে না মেশা। অল্প সময়ের মধ্যে দোকানপাট সেরে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরা।

“জনসমাগম যাতে না হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন ঠিক হয়ে গেছে। আমরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম। অর্থনৈতিক কাজগুলোও চলছিল। এখন অফিস আদলতে বলে দিয়েছি, সীমিত লোক নিয়ে কাজ করতে হবে। বেশি মেশামিশি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য দিতে হবে।”

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। এর মধ্যে ওই বছরের ৫ নভেম্বর মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়িয়েছে। একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর আসে ৩০ জুন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে করোনা ভাইরাসের উপদ্রব শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্বের ২১৩ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছরের ১১ মার্চ কোভিড-১৯ কে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে।

  • 115
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে