বিশ্বব্যাপী শেকলবন্দী লাখ লাখ মানসিক রোগী

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২০; সময়: ৬:২৯ অপরাহ্ণ |
বিশ্বব্যাপী শেকলবন্দী লাখ লাখ মানসিক রোগী

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ৬০টি দেশে লাখ লাখ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। অমানবিক এ বাস্তবতা উঠে এসেছে নতুন এক পূর্ণাঙ্গ গবেষণার আওতায়।

মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এটি প্রকাশ করে। সংস্থাটি জানায়; এশিয়া, আফ্রিকা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা সবখানেই চলছে অমানবিক এ চর্চা। অনেক সময় ১০ বছর বা তার কম বয়সী শিশুরাও যার শিকার হচ্ছে। পায়ে শেকল ও বেড়ি পরিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস বা মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের বন্দী করে রাখা হচ্ছে আবদ্ধ স্থানে।

‘লিভিং ইন চেইনস: শ্যাকলিং অব পিপল উইথ সাইকোলজিক্যাল ডিজাবিলিটিজ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে- সামাজিক অন্ধবিশ্বাস, লজ্জা এবং মানসিক চিকিৎসা সুযোগ না থাকার কারণে পরিবারের লোকজনের হাতে অসুস্থ ব্যক্তিদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই শেকলবন্দী করে রাখার ঘটনা উঠে আসে। তাদের রাখা হয় অস্বাস্থ্যকর বা গাদাগাদি করে রাখার মতো পরিবেশে।

বহুক্ষেত্রে ছোট্ট স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষের ওই পরিবেশেই খাদ্য গ্রহণ, ঘুমানো এবং মলমূত্র ত্যাগে বাধ্য হয় তারা।

এভাবে অবহেলায় আটকে রাখা শুধু বাড়িতে বা পরিবারের মাধ্যমে ঘটছে তা নয়। অনেক দেশের রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে- এমন চর্চা রয়েছে। প্রাচীন পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতো চিরায়ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা।

এসব প্রতিষ্ঠানে কখনো শাস্তি বা চিকিৎসা হিসেবে মানসিক রোগীদের না খাইয়ে রাখা হয়। কখনো জোর করে খাওয়ানো হয় জরিবুটির ভেষজ মিশ্রণ। শারীরিক নির্যাতন-সহ অনেক সময় যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয় রোগীদের।

উত্তর ঘানায় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত এক নারীকে শেকলে পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

হিউম্যান রাইটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়; আফগানিস্তান, বার্কিনো ফাসো, কম্বোডিয়া, চীন, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, লাইবেরিয়া, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, ফিলিস্তিন, স্ব-ঘোষিত সোমালিল্যান্ড রাষ্ট্র, দক্ষিণ সুদান এবং ইয়েমেন-এ করা মাঠ পর্যায়ের গবেষণা এবং সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে।

অনেক দেশের সংস্কৃতিতে অন্ধবিশ্বাস রয়েছে; কৃতকর্ম বা খারাপ আত্মার আছরে মানসিক সমস্যায় ভোগে কেউ কেউ। বিশ্বাসটি থেকেই মানবেতর অবস্থায় পরিবারের লোকজন অসুস্থ সদস্যকে বন্দী করে রাখে।

অন্ধবিশ্বাসের কারণে প্রথমেই অসুস্থ ব্যক্তিটিকে স্থানীয় কবিরাজ বা ধর্মীয় গুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াকে শেষ উপায় হিসেবে বিবেচনা করেন তারা।

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের এমন এক অসুস্থ ব্যক্তি ৫৬ বছরের মুরা। তাকে ১০৩জন তান্ত্রিক ও ওঝার কাছে নিয়ে যান তার পরিবারের লোকজন। বলাই বাহুল্য; ঝারফুঁক, যাদুটোনা তাকে সারাতে পারেনি। বরং মাসের পর মাস তাকে কাটাতে হয় ছোট্ট একটি কক্ষ বন্দী হয়ে।

কেনিয়ায় আরেক মানসিক রোগী পলের সাক্ষাৎকার নেয় এইচআরডব্লিউ। তিনি বলেন, ”আজ পাঁচ বছর ধরে আমি শেকলবন্দী। শেকল অনেক ভারি। এটা পড়ে থাকতে মোটেই ভালো লাগে না; আমি অনেক দুঃখ পাই। ছোট্ট একটি ঘরে আরও সাতজনের সঙ্গে আমাকে রাখা হয়। অন্তর্বাস ছাড়া কোনও কাপড় পরতে দেওয়া হয় না। ভাগ্য ভালো হলে কোনো কোনোদিন সকালবেলা একটু ছাতু জোটে। মাঝে মাঝে রাতে রুটিও দেওয়া হয়, তবে বেশিরভাগ রাতে কিছুই খেতে পাই না।”

বিশ্বব্যাপী বন্দী অবস্থায় এমন নির্যাতনের শিকার ৩৫০ জন মানসিকভাবে অসুস্থের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল শিশু।

দক্ষিণ এশিয়াতেও মানসিক রোগীদের দেখভাল সুষ্ঠুভাবে হয় না।

এইচআরডব্লিউ- এর প্রতিবন্ধী অধিকার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক এবং প্রতিবেদনের লেখক কৃতি শর্মা বলেন, ”মানসিক প্রতিবন্ধীদের শেকলে আটকে রাখার ঘটনা বহুল প্রচলিত। অনেক সমাজ ব্যবস্থায় এটিকে স্বাভাবিক চর্চা হিসেবে রপ্ত করা হয়েছে।”

”অনেককে বছরের পর বছর কোনও গাছের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। কেউ বন্দী থাকে খাঁচায়। আবার ছাগল-ভেড়া পালনের খোয়ারেও স্থান হয় তাদের। পরিবার তাদের সঠিক চিকিৎসা করাণর সামর্থ্যও রাখে না, এবং বেশিরভাগ দেশেই তাদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো মাথাব্যথা নেই,” তিনি যোগ করেন।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখন অনেক দেশ সচেতন হলেও, শেকলবন্দী করে রাখার ঘটনা নিয়ে তেমন সচেতনতা নেই। এবিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য এবং তা নির্মূলে আঞ্চলিক প্রচেষ্টার যথেষ্ট অভাব আছে।

এনিয়ে সচেতনতা তৈরিতে অভিজ্ঞ মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার কর্মী, মানবাধিকার এবং নির্যাতন বিরোধী নানা সন্সথাকে নিয়ে #ব্রেকদ্যচেইনস কর্মসূচি শুরু করতে চলেছে এইআরডব্লিউ। আগামী ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসকে সামনে রেখে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ বা প্রতি ১০ জনে একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একজন একই অবস্থার শিকার। অথচ তারপরও, নানা দেশের সরকার তাদের জনস্বাস্থ্য খাতে দেওয়া মোট বরাদ্দের মাত্র ২ শতাংশ মানসিক চিকিৎসার জন্য ব্যয় করে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

  • 7
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে