ভারতীয় যে রানিরা হয়েছিলেন বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিনের মডেল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০; সময়: ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ |
ভারতীয় যে রানিরা হয়েছিলেন বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিনের মডেল

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : তৃতীয় কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারকে বিয়ে করার জন্য ১৮০৫ সালে মহীশুরে আসেন দেভজামানি। তাদের দুজনেরই বয়স ছিল তখন ১২। এর কিছুদিন আগেই তৃতীয় কৃষ্ণরাজা সিংহাসনে বসেন।

তবে মহীশুরে এসে দেভজামানি আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ শুরু করেন। তিনি গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের প্রচারণার কাজে যুক্ত হন।

ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ ড. নিগেল চ্যান্সেলর জানান, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভ্যাকসিন প্রোগ্রামে জনগণকে উৎসাহিত করতে তার একটি চিত্রকর্ম তৈরি করে।

ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার এর মাত্র ৬ বছর আগেই গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন তৈরি করেন। ভারতের জনগণ তখনো ভ্যাকসিনের ব্যাপারে সন্দিহান ও শঙ্কিত ছিলেন। বিশেষত ভ্যাকসিনটি ব্রিটেনের হওয়ায় উপমহাদেশের জনগণ আরও শঙ্কিত ছিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিন ভারতে নিয়ে আসে। ব্রিটিশ চিকিৎসক, ভারতীয় টিকাদানকারী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান, এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা রাজপরিবারের সদস্যরা ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমে তাদের সাহায্য করেন। ৩০ বছর পর সিংহাসন ফিরে পেতে ইংরেজরা সাহায্য করায়, ওয়াদিয়ার রাজপরিবার ব্রিটিশদের সমর্থনেই ছিল।

হিন্দুমতে পক্সের দেবী। ছবি: গেটি ইমেজ
ড. চ্যান্সেলর জানান, ১৮০৫ সালে আঁকা এই চিত্রকর্ম শুধু রানির ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রমাণই নয়; কীভাবে ব্রিটিশদের চেষ্টা সফল হয়েছিল- তার সূত্রও বটে। চিত্রকর্মটি বর্তমানে সোথবাইয়ের সংগ্রহে রয়েছে। এর সম্ভাব্য মূল্যমান ৪ থেকে ৬ লক্ষ ইউরো।

ড. চ্যান্সেলর জানান, চিত্রকর্মটির সর্বডানের জন ছোট রানি দেভজামানি। সাধারণত তার বাম হাত ঢাকা থাকলেও, তিনি ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন দেখাতেই হাতটি না ঢেকে ছবিটি আঁকা হয়। ছবিটির সর্ববামে রয়েছেন বড় রানি দেভজামানি। তার ছবিতে ভ্যাকসিনের পূর্বে ব্যবহৃত ভ্যারিওলেশনের চিহ্ন দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির শরীর থেকে ফুস্কুড়ির শুকনো চামড়া নিয়ে গুড়ো করে সুস্থ ব্যক্তির নাক দিয়ে প্রবেশ করানো হতো। এর ফলে মৃদু সংক্রমণ হয়েই ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যেত।

ছবিটির ব্যাপারে নিজ বক্তব্যের প্রমাণস্বরূপ ২০০১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি। প্রথমত, চিত্রকর্মের তারিখের সঙ্গে রাজা ওয়াদিয়ারের বিয়ের তারিখ মিলে যায়। ১৮০৬ সালের জুলাইয়ের একটি কোর্ট রেকর্ডে দেখা যায়, রানি দেভজামানির ভ্যাকসিন গ্রহণ জনগণকে ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহিত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। দ্বিতীয়ত, ড. চ্যান্সেলর জানান, স্বর্ণের এ ধরনের ভারী বালা ও মাথার অলংকারগুলো ওয়াদিয়ার রানিদেরই বৈশিষ্ট্য। এছাড়া, চিত্রকর্মটির শিল্পী থমাস হিকি ইতোপূর্বেও রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি এঁকেছিলেন।

তখনকার সময় ব্রিটিশদের জন্য কিছুটা আশঙ্কাজনক ছিল। ১৭৯৯ সালে তারা মহীশুরের টিপু সুলতানকে পরাজিত করে ওয়াদিয়ারদের ক্ষমতায় বসান। তারপরও ইংরেজদের কর্তৃত্বের ব্যাপারে তারা আশ্বস্ত ছিলেন না। তখনই তৎকালীন মাদ্রাজের গভর্নর উইলিয়াম বেন্টিক প্রাণনাশক রোগ প্রতিরোধের কাজে রাজনৈতিক সুযোগ দেখতে পান।

১৭৯৯ সালের যুদ্ধে টিপু সুলতান মারা গেলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। ছবি: গেটি ইমেজ
ভারতের ভ্যাকসিন কার্যক্রমের ইতিহাস ‘ওয়ার এগেইনস্ট স্মলপক্স’ বইয়ে লিপিবদ্ধ করা ইতিহাসবিদ মাইকেল বেনেট জানান, ভারতে বসবাসরত ইংরেজ নাগরিকদের সুরক্ষার জন্যই ব্রিটিশরা এখানে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালাতে উৎসাহিত হন। ইতোপূর্বে ভারতবর্ষে ভ্যারিওলেশন ও ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে গুটিবসন্তের চিকিৎসা করা হতো। হিন্দুরা গুটিবসন্তকে দেবী শীতলার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ মনে করতেন।

গুটিবসন্তের টিকায় কাউপক্স ভাইরাস ব্যবহার করায় এটিকে সহজভাবে গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়াও ব্রাহ্মণ টিকাদাররা, যারা ভ্যারিওলেশন দিতেন, তাদের মধ্যে জীবিকা নির্বাহের পথের ব্যাপারে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন ভ্যাকসিন প্রদানের পদ্ধতির কারণে কাজটি বেশ কঠিন ছিল। এ সকল বাধার কারণে হিন্দু রাজপরিবারের সদস্যদেরই এই কাজে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

১৮০০ সাল থেকেই সরাসরি ভারতবর্ষে ভ্যাকসিন পাঠানোর চেষ্টা চলছিল; প্রতিবারই তা ব্যর্থ হয়। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৮০২ সালে ভিয়েনা থেকে বাগদাদে ভ্যাকসিন পাঠানো হয়। ইরান থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সার্জন বোম্বেতে ভ্যাকসিন পাঠান।

সেসময় এক ব্যক্তির দেহে ভ্যাকসিন দিয়ে তার থেকেই অপর ব্যক্তিকে দিতে হতো।

ভারতবর্ষে ১৮০২ সালের ১৪ জুন অ্যানা ডাস্টহল নামের এক শিশুকে প্রথম ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। পরবর্তী সপ্তাহে অ্যানার হাত থেকে সংগৃহীত ফুস্কুড়ির চামড়া থেকেই আরও পাঁচ শিশুকে দেওয়া হয় ভ্যাকসিন। এভাবেই ভ্যাকসিন ব্রিটিশ অধিকৃত হায়দ্রাবাদ, কোচিন, তেলিচেরি, চিংলেপুট, মাদ্রাজ হয়ে মহীশুরে গিয়ে পৌঁছায়।

রাজপরিবারের আরও সদস্যদের ভ্যাকসিন গ্রহণের কথা জানা গেলেও, কারও এমন চিত্রকর্ম আঁকা হয়নি।

ড. চ্যান্সেলর জানান, রাজার মাতামহ লক্ষ্মী আম্মানি গুটিবসন্তের কারণে তার স্বামীকে হারান। ছবিটির মাঝখানের নারীটি তিনি বলেই মনে করেন ড. চ্যান্সেলর, যার প্রতিকৃতি ওয়াদিয়ার রাজপরিবারের হয়ে ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিচ্ছে। তার কারণেই এই প্রতিকৃতি আঁকা সম্ভব হয়েছিল; কারণ রাজা-রানি দুজনেই তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন।

ইউরোপেও পক্সের ভ্যাকসিনের বিরোধিতা করা হয়
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বুঝতে পেরে জনগণও ধীরে ধীরে ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ভ্যারিওলেশন দেওয়া অনেক টিকাদার ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ শুরু করেন। অধ্যাপক বেনেট মনে করেন, ১৮০৭ সালের মধ্যে ১ মিলিয়নের বেশি টিকা প্রদান করা হয়।

১৯৯১ সালে ড. চ্যান্সেলর এক প্রদর্শনীতে ছবিটি দেখার আগ পর্যন্ত এটি লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল। তারপরই বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিনের প্রথম দিককার ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমে অংশীগ্রহণের কৃতিত্ব পান ভারতীয় এই রানিরা।

  • 10
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে