কোভিড থেকে সদ্য সেরে ওঠাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে ব্যায়াম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০; সময়: ২:২৪ অপরাহ্ণ |
কোভিড থেকে সদ্য সেরে ওঠাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে ব্যায়াম

পদ্মটাইমস ডেস্ক : কোভিড-১৯ মূলত শ্বাসযন্ত্রের রোগ হলেও এর সংক্রমণ শুধু ফুসফুসকেই আক্রান্ত করে না। মহামারির শুরুর দিক থেকেই চিকিৎসকরা লক্ষ করেছেন, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফুসফুসের পাশাপাশি মস্তিষ্ক, রক্তনালি ও হৃদযন্ত্রেও ছড়াতে পারে।

চীন, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিককার তথ্য থেকে দেখা যায়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রোগীর হৃদরোগের উপসর্গ ছিল।

এধরণের রোগীরা হৃদরোগের উপসর্গবিহীন রোগীদের তুলনায় বেশি অসুস্থ হন এবং তাদের মৃত্যুহারও বেশি; তবে এটি তাৎক্ষণিকভাবে আশঙ্কা সৃষ্টি করেনি। তারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো গুরুতরভাবে অসুস্থ ছিল। ভাইরাসের সংস্পর্শে আসা বেশিরভাগ ব্যক্তির-ই মৃদু- গুরুতর উপসর্গ ছিল। প্রতি তিনজনে একজন ব্যক্তির আক্রান্ত অবস্থায় শারীরিক জটিলতা দেখা যায়না।

তবে বর্তমানে গবেষণার পর প্রমাণ মিলেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির মৃদু উপসর্গ বা উপসর্গ না থাকলেও ভাইরাসটি হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে, বিশেষত যারা আক্রান্ত অবস্থায় শরীরচর্চা করেন।

গতমাসে বিগ টেন ও প্যাক-১২ কলেজ কনফারেন্স ২০২০ মৌসুম স্থগিত করার অন্যতম কারণ হিসেবে হৃদপিণ্ডের প্রদাহজনিত রোগ মায়োকার্ডিটিসের কথা উল্লেখ করেন। এটি নতুন আবিষ্কৃত কোনো রোগ নয়, সচরাচর এটি দেখাও যায়না। সাধারণত ভাইরাল সংক্রমণের ফলেই এটি হয়।

আক্রান্ত ব্যক্তি বিশ্রামে থাকলেই এটি ধীরেধীরে সেরে যায়। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি এসময় পরিশ্রমের কাজ বা শারীরিক কসরত করলে পা ফুলে যাওয়া, মাথা ঘোরা ও শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের আশঙ্কা থাকে; এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

ক্রীড়াবিদরা এই রোগে আক্রান্ত হলে গুরুতর পরিণাম হতে পারে। একারণেই মহামারি পরবর্তী খেলাধুলার ব্যাপারে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। গত মাসে ফ্লোরিডার বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাইকেল ওজো সার্বিয়ায় খেলার পর হৃদযন্ত্রের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২৭ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় কিছুদিন পূর্বেই কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন।

ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সৌরভ রাজপাল জানান, এধরণের মর্মান্তিক ঘটনা এড়াতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নতুন নীতিমালা নির্ধারণ করেছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্য লাভ করা শিক্ষার্থীদের পুনরায় খেলার মাঠে ফিরতে রক্তপরীক্ষা, ইলেকট্রকার্ডিওগ্রাম, এমআরআই সহ সম্পূর্ণ মেডিকেল পরীক্ষণ করিয়ে সুস্থতার ছাড়পত্র নিতে হবে।

জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৬ জন নারী ও পুরুষ খেলোয়াড় কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্য লাভ করার পর মেডিকেল পরীক্ষণ করান। তাদের চারজনের মধ্যে মায়োকার্ডিটিসের লক্ষণ দেখা যায়, চারজনের মধ্যে দুইজনই কোভিড-১৯ আক্রান্ত অবস্থায় উপসর্গবিহীন ছিলেন।

জেএএমএ কার্ডিওলজি জার্নালের গবেষণা প্রতিবেদনে গত শুক্রবার এটি প্রকাশিত হয়।

এই গবেষণার সাথে যুক্ত সৌরভ রাজপাল বলেন, “অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণের কারণে মায়োকার্ডিটিস দেখা যায়, সার্স-কোভ-২ ও ব্যতিক্রম নয়। কোভিড-১৯ হৃদযন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে এটি মানুষের জানা জরুরি। ”

এর প্রভাব শুধু খেলোয়াড়দের ওপরেই পড়ে না। ১০০ জন সাধারণ মানুষের ওপর করা জার্মানির একটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, তাদের ৭৮ জনের মধ্যেই বিভিন্ন মাত্রায় হৃদযন্ত্রের জটিলতা দেখা যায়। তাদের মধ্যে ১২ জনই আক্রান্ত অবস্থায় উপসর্গ বিহীন ছিলেন। মৃদু উপসর্গ থাকলেও হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে বলে জানান গবেষকরা।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইন্সটিটিউট এর পরিচালক এরিক টোপল জানান, এই ক্ষতির আসল প্রকৃতি সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি। আরও বড় পরিসরে এই গবেষণার কাজে সরকার ও গবেষণা অনুদানকারীদের এদিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে এতোদিনে কোভিড-১৯ এ ৫০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। (নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা ৬.৫ মিলিয়ন হলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী এর ১০ গুণ বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।) আক্রান্ত আমেরিকানদের ১ শতাংশও হৃদযন্ত্রের জটিলতার সম্মুখীন হলেও তা প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ। একারণেই এব্যাপারে যতো দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।”

কোভিড-১৯ আক্রান্তদের হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া নাকি ভাইরাসটি সরাসরি হৃদপিণ্ডে সংক্রমণ ঘটায় এব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন।

তবে হৃদপিণ্ডের কোষে ভাইরাসের আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম২ (এসিই২) আছে। এছাড়াও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করা রোগীর ময়নাতদন্তে রোগীর হৃদপিণ্ডে ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা গেছে।

সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক গ্ল্যাডস্টোন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা থেকে দেখেন, গবেষণাগারে মানুষের হৃদপিন্ডের কোষে ভাইরাসটিকে স্থাপন করা হলে তা হৃদপিণ্ডের পেশীতন্তুকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

গবেষণাটির সাথে যুক্ত ব্রুস কঙ্কলিন জানান, অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রেই এতো বিরূপ প্রভাব দেখা যায়নি। তবে ভাইরাসটি ঠিক কিভাবে মানবদেহকে আক্রান্ত করে এব্যাপারে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন ।

অনেক মানুষ নিজেরাই জানেন না তারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাই তারা অজান্তেই শারীরিক কসরতের কাজ করতে পারেন, শরীরচর্চা করতে পারেন যার ফলে তাদের হৃদযন্ত্রের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। অপেশাদার ম্যারাথনার, আল্ট্রারানার ও ট্রায়াথলেটিদের জন্য এই ঝুঁকি আরও বেশি, কারণ তারা নিয়মিত মেডিকেল পরীক্ষণ ছাড়াই দীর্ঘপথ দৌঁড়ে থাকেন।

যেকোনো ধরণের শরীরচর্চা করার সময় বুক ব্যথা, শ্বাসপ্রশ্বাসে অসুবিধা বা যেকোনো ধরণের অস্বাভাবিক লক্ষণ খেয়াল করলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন সৌরভ রাজপাল। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে সুস্থ হবার পরেও স্বাভাবিক মাত্রায় অনুশীলন শুরু করার আগে কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম প্রয়োজনীয় বলেও জানান তিনি।

ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির যেসব খেলোয়াড়দের মধ্যে মায়োকার্ডিটিসের লক্ষণ দেখা গেছে, তাদের বাধ্যতামূলক ৩ মাসের বিশ্রামের পরামর্শ দেয়া হয়। রাজপাল জানান, এই নির্ধারিত সময়ের পরে পুনরায় পরীক্ষণে প্রদাহজনিত কোনো লক্ষণ না থাকলে তবেই তাদের পুনরায় খেলার অনুমতি দেয়া হবে।

  • 15
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে