টেলিমেডিসিনের চেয়ে সরাসরি রোগী দেখার পক্ষেই অভিমত চিকিৎসকদের

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২০; সময়: ১২:৪৩ অপরাহ্ণ |
টেলিমেডিসিনের চেয়ে সরাসরি রোগী দেখার পক্ষেই অভিমত চিকিৎসকদের

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সরাসরি রোগী না দেখায় নিজে সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত থাকলেও, মানসিক শান্তি উড়ে গেছে অনেক চিকিৎসকের। রোগীর উপকার না ক্ষতি হচ্ছে- টেলিমেডিসিনের ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, তা নিয়েই চিন্তিত অনেকেই। তাদের একজন ডা. পল হাইম্যান। প্রযুক্তির এমন ব্যবহারে নিজ উদ্বেগের কথাও তুলে ধরেছেন সম্প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাময়িকী- জামা ইন্টারনাল মেডিসিন- জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে।

 

রোগীর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি এবং তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার নানা পরীক্ষা সরাসরি করার সুযোগ টেলিমেডিসিনের কারণে হারিয়েছে, এমন অভিযোগ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের। ছবি: এনপিআর

 

 

 

 

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদিকথা:

প্রাচীন মানুষ বিশ্বাস করতো অসুখ-বিসুখ দৈবশক্তির প্রভাবের ফসল। পাপাচারের প্রায়শ্চিত্য বা পূর্বজন্মের মাসুল। অশুভ শক্তির প্রভাবও ধরে নেওয়া হতো গুরুতর অসুখের ক্ষেত্রে। চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলিত যে ধারা আজ আমরা দেখি, তা ছিল না মোটেই। সেখানে বৈদ্যের চাইতে বেশি গুরুত্ব পেতো ওঝা বা ধর্মীয় পুরোহিত। ওষুধের চাইতে বেশি প্রাধান্য পেতো দৈবশক্তির কাছে প্রার্থনা আর ভেট।

সবকিছুই বদলে দেন আজ থেকে ২৪শ’ বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে জন্ম নেওয়া এক ব্যক্তি- হিপোক্রাটিস। তাকে বলা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক। কারণ তিনিই প্রথম রোগী দেখা এবং উপসর্গ অনুসারে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেন। বৃথা প্রার্থনার চাইতে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনের প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছেন- এথেন্সের বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের যুগে বসবাসকারী এ চিকিৎসক।

বস্তুত, হিপোক্রাটিস ও তার শিষ্যদের হাত ধরেই দেবভক্তির চরম যুগে আবির্ভাব ঘটে বিধিসম্মত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মটির। বহু শত বছর পরে আরবরাও প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান অনুবাদ করে নিজ ভাষায়। তাদের হাত ধরে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে পুনর্জন্ম লাভ করে চিকিৎসক আর রোগীর বিজ্ঞানসম্মত আরোগ্যের সম্পর্ক।

অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রোগীর লক্ষ্মণ পরীক্ষার এ পদ্ধতি হিপোক্রাটিসের বহু আগে থেকেই চলে আসছিল। তিনি শুধু একে ধারাবাহিক বিজ্ঞানে রূপ দিয়েছেন। তাই বলা যায়, রোগীকে পরীক্ষার এ ধারা চিকিৎসা শাস্ত্রের জনকের চাইতেও প্রাচীন।

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক খ্যাত হিপোক্রাটিস।

 

 

 

 

 

 

 

তবু ভিন্ন মহামারির কাল:

প্রতি শতাব্দীতে পৃথিবীতে এক প্রলয়ঙ্করী মহামারি দেখা দেয়, যার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি গত সহস্র বছরে। মহামারি আমাদের চারপাশের আর্থসামাজিক, মানবিক পরিবেশ বদলে দেয়। বদলে দেয় নগর আর জনপদকে। আর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে চিকিৎসা শাস্ত্রে। চলমান করোনাভাইরাসের মহামারিও তার ব্যত্যয় করেনি।

এ মহামারি হচ্ছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের যুগে। লকডাউন আর শাটডাউনের যুগে। তাই চিরায়ত পদ্ধতির সরাসরি রোগী দেখার চাইতে এখন বেশি প্রচলিত হয়ে উঠছে টেলিমেডিসিন। করোনার সঙ্কট আরো বেশি করে রোগীদের চিকিৎসা পরামর্শ পেতে করেছে অনলাইনমুখী। আর এ ঘটনা ঘটছে পুরো বিশ্বেই।

চিকিৎসা পদ্ধতি ঘিরে চিকিৎসকদের উদ্বেগ:

রোগী দেখা এড়িয়ে নিজে সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত থাকলেও, মানসিক শান্তি উড়ে গেছে অনেক চিকিৎসকের। রোগীর উপকার না ক্ষতি হচ্ছে- টেলিমেডিসিনের ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, তা নিয়েই চিন্তার অন্ত নেই অনেকের। এদেরই একজন ডা. পল হাইম্যান। তিনিও এখন কম্পিউটারের পর্দায় ভার্চুয়ালি রোগী দেখছেন। কিন্তু, এনিয়ে নিজের উদ্বেগের কথাও তুলে ধরেছেন সম্প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাময়িকী- জামা ইন্টারনাল মেডিসিন- জার্নালে প্রকাশিত তার নিবন্ধে।

হাইম্যান যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্য মেইনে বসবাস করেন। ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনেকটা আন্দাজের উপর ভিত্তি করেই রোগী দেখতে হচ্ছে তাকে। স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির চাপে বাধ্য হয়েই এখন অনলাইনে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার চেষ্টা করছেন রোগীরা। কোম্পানিগুলো আদতে রোগীর কতটুকু উপকার করছে- নাকি তাদের ফলদায়ক চিকিৎসার সুযোগ বঞ্চিত করা হয়েছে, সেটা নিয়েও নিজের অভিমত দিয়েছেন হাইম্যান।

তিনি জানান, বাধ্য হয়ে ভার্চুয়ালি চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হলেও, তার মতো অনেক চিকিৎসকই এখন নতুন করে সরাসরি রোগী দেখা ও তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার হাজার বছর পুরোনো পদ্ধতির গুরুত্ব নতুন করে অনুধাবন করতে পারছেন। এতে চিকিৎসক নিজেও ভারমুক্তি লাভ করেন। মানবসেবার অনুভূতি পান, সরাসরি রোগী দেখায় ভুল চিকিৎসা নিয়ে দুর্ভাবনা কমে। তাছাড়া, রোগীর প্রয়োজনে উপস্থিত থাকার মধ্য দিয়ে ডাক্তার হিসেবে নিজের পেশাগত সন্তুষ্টির প্রাপ্তি তো আছেই।

”চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তারা যখন রোগীর গায়ে হাত দেন, তার মধ্যেই বড় একটি মানসিক থেরাপি থাকে রোগীর জন্য। সাম্প্রতিক প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটি আমি নিজের এমন অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছি। আমার সঙ্গে, একমত পোষণ করে অনেক চিকিৎসক ইতোমধ্যেই সরাসরি রোগী দেখার জাদুকরি প্রভাবের বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন। শারীরিক পরীক্ষা ছাড়া এ প্রভাবটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করেছেন তারা” বলছিলেন হাইম্যান।

মার্কিন গণমাধ্যম এনপিআর’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। অতি-প্রযুক্তি নির্ভরতা চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যেকার মানবিক সম্পর্ক মুছে ফেলার হুমকি তৈরি করেছে বলেও সেখানে তিনি উল্লেখ করেন। ওই আলাপনের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো;

প্রশ্ন: চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতিকে আকস্মিকভাবে কীভাবে টেলিমেডিসিন প্রভাবিত করছে?

ডা. পল হাইম্যান: পরিবর্তনটা প্রতিনিয়ত হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহেই আমাকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগী দেখার নতুন নতুন উপায় শিখতে হচ্ছে। তারপরে আবার ভাবতে হচ্ছে; ভার্চুয়াল মাধ্যমে রোগীর সম্পর্কে কী জানলাম, আর কোনটা বাদ পড়লো। একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হয়েও আমাকে নতুন করে শিখতে হচ্ছে, বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলাতে। অথচ ভার্চুয়াল চিকিৎসা বাস্তব ঠেকে না মোটেই। বিষয়টি বেশ জটিল।

সত্যি বলতে কী রোগীকে সরাসরি দেখা তাকে পরীক্ষা করার সুযোগের অভাব অনুভব করছি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে এ সুযোগ না থাকায় আমাকে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে। রোগী পরীক্ষার সুযোগ পেলে কী জানতে পারতাম, তা আমাকে অনুমানও করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র রোগীর স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি ঝুঁকি দেখা দিলেই, তখনই কেবল তাকে সরাসরি পরীক্ষার জন্য আসতে বলছি আমরা।

অবশ্য এটাও ঠিক, রোগীর থাকার জায়গা, তাদের যাপিত জীবনের পরিবেশ বা আবাসন সম্পর্কে ভার্চুয়াল মাধ্যমে একটা ধারণা লাভ করা যায়। এটা তাদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও একটা ধারণা দেয়, ফলে চিকিৎসায় তারা কতটুকু খরচ করার সামর্থ্য রাখেন বা সেটা তাদের কাছে কয় নম্বর গুরুত্বের বিষয়- তা জানতে পারছি। আমার মনে হয়, রোগীদের সঙ্গে ভিন্ন মাত্রার এক সম্পর্ক তৈরি করছে এ চিকিৎসা পদ্ধতি।

প্রশ্ন: সরাসরি পরীক্ষায় কোন বিষয়গুলো সহজেই ধরা পড়তে পারতো যা টেলিহেলথে এড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি?

হাইম্যান: বিষয়টা পুরোপুরি আমরা অনেকেই বুঝে উঠতে পারিনি, কারণ এভাবে চিকিৎসাও আগে আমরা দেইনি। উদাহরণ হিসেবে এমন একজন রোগীর কথা বলা যায়, ধরুন তার হৃদযন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে না এবং সেকারণে তার শরীরে রস জমা শুরু করেছে। এমন অবস্থায় রোগীর পক্ষে ফোনে বা ভিডিও চ্যাটে নিজের প্রকৃত শারীরিক অবস্থার কথা অনুমান করে চিকিৎসককে জানানো সম্ভব নয়। এজন্য দরকার রোগীকে স্পর্শ করা, তাদের হৃদস্পন্দনের গতি মাপা, পায়ের দিকে লক্ষ্য করা, রক্তচাপ মাপার মতো সরাসরি পরীক্ষা পদ্ধতি।

আরেকটি যে বিষয় নিয়ে আমি উদ্বেগে ভুগি তা হচ্ছে রোগীদের মাথা ঝিমঝিম করার বিষয়টি। কারণ, বহুবিধ কারণে রোগীদের মধ্যে এটা দেখা যেতে পারে। কিছু কিছু কারণ খুবই সাধারণ এবং তা নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই। তবে ক্ষেত্রবিশেষে কারণটি মারাত্মক কোনো রোগের উপসর্গ হতে পারে। ভিডিওচ্যাটে এসব লক্ষ্মণের পার্থক্য নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন।

প্রশ্ন: পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের আর কোন বিষয়টি হারিয়েছে বলে আপনি মনে করছেন?

হাইম্যান: এবিষয়ে আমি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্রাহাম ভারগাসের চিকিৎসা রীতির বর্ণনার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলতে চাই, অবশ্যই রোগীর ডাক্তারের চেম্বারে আসা এবং তারপর তার স্বাস্থ্যগত ইতিহাস পরীক্ষা করে দেখার ধারাবাহিকতা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ধর্মের চাইতে কোনো অংশে কম আনুষ্ঠানিকতার বিষয় নয়। এর মধ্যে দিয়ে রোগী আর চিকিৎসক দুজনেই শান্তি পান। আমার নিবন্ধেও সেকথাই লিখেছি।

পরীক্ষা প্রকৃত তথ্য পাওয়ার প্রধান লক্ষ্য বলেছি আমি। কিন্তু, এটা মাথায় রাখতে হবে যে, রোগী তার অসুস্থতার কথা তুলে ধরেন আর চিকিৎসক সে অনুসারে পরীক্ষা করে তার অবস্থা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তাকে আশ্বস্ত করতে চান। এব্যাপারে রোগীর লক্ষ্য থাকে আশ্বাস পাওয়া, আর চিকিৎসক সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য সন্ধানে থাকেন। কিন্তু, সফল পরীক্ষার শেষটাই হচ্ছে চমকপ্রদ। কারণ ডাক্তার জানতে পারেন রোগীর প্রকৃত অবস্থা আর রোগীও তখন তা জেনে নিতে চান। এভাবেই একটা নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। আস্থার এ বন্ধন ভাঙ্গলে রোগী সাহস কোথায় পাবেন!

আজ আমাদের দুনিয়ার ইলেক্ট্রনিকভাবে রেকর্ডকৃত স্বাস্থ্যের তথ্য এবং অন্যান্য অনেক বাতুলতা চিকিৎসককে তার প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিভ্রান্ত করতে পারে। রোগীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করার যে সুযোগটা পাওয়া যায়, সেটাই আসলে মুখ্য বিষয়। ওই অবস্থায় আমি সম্পূর্ণরূপে রোগীর জন্য সহায়ক, অর্থপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সেবা পাওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারি।

(সংক্ষেপিত)

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে