দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২২; সময়: ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ |
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : অভাব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবনধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

একদিকে করোনার প্রভাবে কর্মহীন মানুষ, অন্যদিকে বন্যায় সবজিতে ব্যাপক ক্ষতি। সব মিলিয়ে কাঁচাবাজারের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত।

মধ্যবিত্তের কথা
শাহাদাত হোসেন শিবলী। মতিঝিলে একটি ব্যাংকে মাঝারি মানের পোস্টে কাজ করেন। ভরদুপুরে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন তিনি। দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি-কলা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সাধারণ রেস্তোরাঁগুলোতে এক বেলা সবজি, ডাল ও ভাত খেতেও ৮০ টাকা লেগে যায়। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি দুপুরে রুটি-কলা খেয়ে কাটানো শুরু করেছেন।

জানতে চাইলে, শিবলী সংসারে ব্যয় বাড়ার খতিয়ান তুলে ধরেন। বলেন, গত মাসে তার বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে। সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে রিকশাভাড়া লাগত ২০ টাকা করে ৪০ টাকা। এখন লাগে ৬০ টাকা। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ সব পণ্যের দামই বাড়তি। অফিসে যাওয়া-আসা করতেও বাসভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু তার আয় দুই বছর আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে।

শিবলীর মতো সাধারণ মানুষের সংসারে ব্যয়ের বড় খাত চারটি—খাদ্য ও ঘরকন্নার উপকরণ কেনা, বাসাভাড়া ও সেবার বিল, সন্তানদের পড়াশোনা এবং পরিবহন। দেশে এই চারটি খাতেই একসঙ্গে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম অবস্থা মানুষের।

বাজারে এখন তেলের দাম চড়া। সাম্প্রতিককালে চাল, ডাল, চিনির দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বেড়েছে সংসারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ভাড়া এক লাফে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। করোনার কারণে না বাড়ালেও এ বছর বাড়ির মালিকেরা বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের বেতন ও খাতা-কলমের দামও বাড়তি।

শাহাদাত হোসেন শিবলী বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। ধনীদের কথা আলাদা।

কতটা বেড়েছে দাম
আওয়ামী লীগ সরকার এই মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছিল ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওই দিনের বাজারদরের তালিকা ও গত বৃহস্পতিবারের তালিকা ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোটা চালের দাম ৯, মোটা দানার মসুর ডাল ৭৫, খোলা সয়াবিন তেল ১২৯ ও আটার দাম ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।

শুধু ভোজ্যতেলের কথা ধরা যাক। মধ্যম আয়ের পাঁচজনের একটি পরিবারে গড়পড়তা ৫ লিটার সয়াবিন তেল লাগে। টিসিবির হিসাবে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৬৫ থেকে ৫১০ টাকা, এখন তা ৯৭০ থেকে ৯৯০ টাকা। কোথাও কোথাও তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মানে হলো, শুধু সয়াবিন তেল কিনতে একটি পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১২০ শতাংশ।

কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। তবে বিগত এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছরজুড়েই বেশি থাকছে। যেমন ব্রয়লার মুরগির দাম এখন বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি কেজি ১৫০ টাকার বেশি থাকে। করোনার আগেও এই দর ১২৫-১৩০ টাকার আশপাশে থাকত। বিক্রেতাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, খাবারের দাম ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই আর আগের দামে ফেরার আশা কম।

সীমিত আয়ের পরিবার কালেভদ্রে এখন গরুর মাংস কিনতে পারে। এখন বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা। তিন বছর আগে এই সময়ে ছিল ৫০০ টাকার নিচে।

রমজানের শুরুতেই বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছিল। পুরো রমজানে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এই ধাক্কা সামলানোর আগেই এখন নতুন করে বাজারে বিভিন্ন মুদিদোকান ও কাঁচাবাজারের খাদ্যপণ্য নয় শুধু, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও। ঈদের পর গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, ডিমসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে।

ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলা সিটি করপোরেশন মার্কেটের ‘কাজল ট্রেডার্স’ নামে একটি মুদিদোকানের মালিক কাজল মিয়া বলেন, ঈদের আগে এতো দাম ছিল না, ঈদের দুইদিন পরে সব দাম বেড়ে চলেছে। এক বক্স টিস্যু পেপারের দাম ১০ টাকা বেড়েছে। ৯০ টাকায় এক কেজি গুঁড়া সাবান পাওয়া যেত। এখন তা ১০৫-১১০ টাকা। বেড়েছে অন্যান্য জিনিসের দামও।

কথা হয় ‘খুশি ট্রেডার্স’ এর মালিক খুশি আপার সাথে। তিনি জানান, ঈদের আগে পেঁয়াজ বিক্রি করছি ২৫ টাকায়, এখন এটা ৪৫ টাকায় বিক্রি করছি। ডিম বিক্রি করছি হালিতে ৩৬ টাকা, এখন ৪০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

মেসার্স তালতলা ট্রেডার্র এর রকিব উদ্দিন বলেন, সব জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। শুক্রবারে মানুষের ঢল নামতো এ মার্কেট, এখন একদমই মানুষ নাই। মানুষের কেমনে কিনবে, মানুষের হাতে টাকা নাই। আর আমাদের মতো ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপ।

শিক্ষা উপকরণের দাম কতটা বেড়েছে, তা তুলে ধরেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়সংলগ্ন ‘কলেজ লাইব্রেরি’ নামের একটি দোকানের বিক্রেতা আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, একটি খাতার দাম ২০ থেকে বেড়ে এখন ২৫ টাকা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেনসিলের দাম। ১০ টাকার একটি পেনসিলের দাম ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।

যাদের বাড়িতে সরকারি কোম্পানির গ্যাসলাইন নেই, তারা বিপাকে আছেন সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালের শুরুতে যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডার (১২ কেজি) ৮০০-৮২০ টাকা ছিল, তা এখন সাড়ে পনের শ টাকা।

তেলের তেলেসমাতি
করোনার ধাক্কায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থা টালমাটাল। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভিন্ন হওয়ার কিছু নয়। যেহেতু অধিকাংশ নিত্যপণ্যের জন্য আমদানির ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুনে পুড়তেই হচ্ছে মানুষকে। সেই আগুনে ঘি ঢালল ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি। এরপরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন, ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে, মজুতও যথেষ্ট পরিমাণে আছে ফলে কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়; তাহলে চাল কিনতে কেন সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে? সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এর উত্তর হতে পারে দুইটি—হয় উৎপাদন ও মজুদ নিয়ে সরকার সঠিক তথ্য দেয়নি, বাড়তি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে অথবা বাজারে সিন্ডিকেট করে এই অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে।

সরকারের এক মন্ত্রী তো বলেই দিলেন, বিএনপির ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। কথা হচ্ছে, বিএনপি যেখানে মিছিল-সমাবেশ করতে রাস্তাতেই নামতে পারে না, সেখানে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গোটা দেশে অস্থিরতা তৈরি করে দিয়ে এত বড় ‘সাফল্য’ দেখিয়ে ফেলল!

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে