কোভিডে রপ্তানি বন্ধ, গভীর সংকটে নারী কাঁকড়া চাষিরা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০; সময়: ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ |
কোভিডে রপ্তানি বন্ধ, গভীর সংকটে নারী কাঁকড়া চাষিরা

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ বৈরি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচেন। প্রতিদিনই নতুন সংগ্রাম, তাদের টিকে থাকার চেষ্টা। এর মধ্যেই নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা করেন তারা। খোঁজেন জীবিকার নতুন সুযোগ। উপকূলীয় এলাকায় ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার মাঝে নতুন করে আসার আলো জাগিয়েছিল কাঁকড়া চাষ।

চীনসহ নানা দেশে রপ্তানি বাজার থাকায় চাষকৃত কাঁকড়ার চাহিদাও বাড়ছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর পরিহাসের মতোই তখন হানা দিল কোভিড-১৯ মহামারি। এশীয় দেশটিতে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিদের কমবেশি সকলেই বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েন।

তবে সহায়সম্বলহীন যে নারীরা একে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন, তারা পড়েছেন ঘোর সংকটে। তাদের আয়ের ওপরই নির্ভর করত পরিবারের দু’মুঠো খাবার। ফলে পরিবার নিয়ে এখন প্রায় আনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের।

কাঁকড়া চাষি নারীদের এ অনটন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা- ভলেন্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) সতর্ক করেছে।

সংস্থাটি জানায়, মোংলায় কাঁকড়া আহরণের ভরা মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশজুড়ে চলা লকডাউন এবং আকর্ষণীয় রপ্তানি বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শুধু চাষিরা নন, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক জিডিপিও আংশিক প্রভাবিত হয়েছে।

প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এ রপ্তানি চাহিদা মেটানোর ওপর উপকূলের অসংখ্য মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল বলে জানায় সংস্থাটি। নারীদের সামাজিক ক্ষমতায়নেও এ শিল্পের আয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই নিজ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেন এ আয় দিয়েই।

‘চীনের মতো লাভজনক বাজারে সহসাই রপ্তানি বাজার খোলার আশা করছেন না ঢাকাভিত্তিক রপ্তানিকারকেরা। এ অবস্থায় বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলেও অনেক শিশু বিদ্যালয়ে আর ফিরতে পারবে না। তারা এবং তাদের পরিবার এক কঠিন অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে,’ বলছিলেন ভিএসও’র প্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান।

তার অধীনে সংস্থাটি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য বাজারে জ্যান্ত কাঁকড়া রপ্তানিতে নারীদের একটি সমবায় সমিতি গঠন করেছিল। সমবায়ের সদস্য সংখ্যা ৩৫৮ জন। এর বাইরে ইউরোপেও হিমায়িত কাঁকড়া রপ্তানির সহায়তা দিত ভিএসও প্রকল্পটি।

ভিএসও’র সমবায়টির নারী সদস্যদের বাৎসরিক আয় মহামারিপূর্ব সময়ে বেড়ে ৫৮০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৬২ হাজার ৮৯৬ টাকায় উন্নীত হয়েছিল, যা দেশের কম দক্ষ শ্রমিকদের বাৎসরিক আয়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি।

‘সমবায়ের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছিলাম, নারীরাও সমানভাবে সমাজে অবদান রাখতে পারেন, পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা যোগ করতে পারেন। প্রযুক্তি ও বাজার সহায়তা পেলে তারা দারুণ কিছু করে দেখাতে সক্ষম, এমনটাই দেখা যাচ্ছিল,’ শফিকুর রহমান যোগ করেন।

সমবায়টি নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী বিকাশেও সহায়তা করত।

ভুক্তভোগীর কথা
২০১৪ সাল থেকে কাঁকড়া চাষের সঙ্গে জড়িত সাথী দাস বর্তমানে সমবায়টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারির শেষেই বন্ধ হয়ে যায় ঢাকায় কাঁকড়ার পাইকারি বাজার। চীনা ক্রেতারা এখান থেকেই বড় পরিমাণে কাঁকড়ার চালান কিনে নিয়ে যেতেন। এখন আমি নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি।’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান প্রতিনিধিকে সাথী বলেন, ‘আমার কোনো সঞ্চয় নেই। যা সম্বল ছিল সব বেঁচে পরিবার নিয়ে টিকে আছি। এখন বিক্রি করার মতো জিনিসপত্রও ফুরিয়ে আসছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীর ব্যবসাও এখন অর্থ সংকটে। দুজনে মিলে খাওয়ার টাকাও যোগার করতে পারি না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার নিয়ে নিয়ে চলছি। কবে বা কীভাবে এই দেনা শোধ করব, আদৌ শোধ করতে পারব কি না- জানা নেই। খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়েই কঠিন এ সময় পার করছি।’

চাষ করা কাঁকড়ার একটি ভোক্তাবাজার দেশেও গড়ে উঠেছিল মহামারির আগে। কিন্তু রপ্তানি বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে এর মূল্য রাতারাতি পড়ে যায়। আগে যেখানে স্থানীয় বাজারে হাজার টাকা কেজিতে কাঁকড়া বিক্রি হতো, এখন সেই মূল্য ৮০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২০০ টাকায়। ফলে স্থানীয় পাইকারদের কাছে তাদের নির্ধারিত মূল্যেই লোকসানে বেচতে হচ্ছে কষ্টের ফলন।

শফিকুর রহমান বলেন, ‘চীনে আসন্ন মধ্য-শরৎ উৎসবে কাঁকড়া খাওয়ার খুব চল রয়েছে। সেখানে রপ্তানি করা গেলে এই মুহূর্তে চাষিরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। কিন্তু ঢাকার রপ্তানিকারকরা বলছেন, রপ্তানি বাজারটি অচিরেই খুলবে- এমন কোনো সম্ভাবনা তারা দেখতে পাচ্ছেন না।’

বিকল্প উপায় হিসেবে এখন অনেকেই চিংড়ি চাষ করছেন
এ অবস্থায় কাঁকড়া চাষের পুকুরে মাছ ও চিংড়ি ছেড়েছেন নারী চাষিরা। এসব চাষে যেমন পরিশ্রম বেশি, ঠিক তেমনি ন্যায্য বাজারদর পাওয়াটাও অনিশ্চিত তাদের জন্য।

ভিএসও জানায়, সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানেও তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। অনেকেরই মাছের ঘের ভেসে গেছে। লোনা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয় অনেকের জমির ফসল। অর্থাৎ উপার্জনের বিকল্প পথ নেই নারীদের, যেখান থেকে তারা মাছ বা চিংড়ি চাষে দরকারি বিনিয়োগটা করতে পারতেন।

সাথী দাস জানান, পরিবারের আগের সেই স্বচ্ছলতার দিনগুলো এখন তার খুব মনে পড়ে। যেকোনোভাবে তিনি আবার সংসারে সাহায্য করতে চান। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।

‘মোংলায় সমাজ খুবই রক্ষণশীল। এখানে নারী হয়ে কাজ করা আর পরিবারকে সাহায্য করা খুব একটা সহজ নয়। এ সংগ্রাম আমি আগেও করেছি। আশা করি, খুব শিগগিরই কাঁকড়া চাষ শুরু করে, মহামারির আগের সেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পাব,’ তিনি যোগ করেন।

  • 17
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে