দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘দুর্নীতিবাজরা’

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২০; সময়: ১০:৩৯ অপরাহ্ণ |
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘দুর্নীতিবাজরা’

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনা মহামারিতে বন্ধ রয়েছে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপিঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ-পরীক্ষাসহ সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম। কিন্তু বন্ধের এমন দিনেও দুর্নীতির নানা খবরে শিরোনাম হয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউাজিসি) এবং প্রধানমন্ত্রী দফতর বরাবার অভিযোগ করে আসছেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ। এ নিয়ে তদন্তও করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

অন্যদিকে ইউজিসি কর্তৃক তদন্তের সমালোচনা করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আবদুস সোবহান। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং প্রশাসনবিরোধী এমন অবস্থানের কথা সবার জানা।

কিন্ত প্রশ্ন ওঠেছে, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা মাঠে না নামলেও আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা কেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন সরব হচ্ছেন? আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারা? তাদের উদ্দেশ্যই-বা কী? আগের প্রশাসনের করা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের কী ভূমিকা ছিল? এমন সব প্রশ্ন ক্যাম্পাসে মানুষের মুখে মুখে।

উপাচার্য আবদুস সোবহান ও তার প্রশাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সুলতান-উল-ইসলাম টিপু। অথচ, খোদ টিপুর বিরুদ্ধেই ভয়ঙ্কর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

২০১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৪৭০তম সভায় ৮২ লাখ ৬৫ হাজার ১৬১ টাকার অনুমোদন দেয়া হয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক’ প্রকল্পের জন্য। স্মৃতিফলকে তিনজন শহীদ শিক্ষক এবং বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাস্কর্য নির্মাণে ১৪শ কেজি তামার জন্য ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

কিন্তু তাতে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ৪৯২ কেজি তামা! প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় ৮৩ লাখ টাকার পুরো হিসাবেই গড়মিল পেয়েছে তদন্ত কমিটি। আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির একটি প্রতিবেদনে দুর্নীতির এমন চিত্র উঠে এসেছে।

তৎকালীন পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুলতান-উল-ইসলাম টিপুকে সমন্বয়ক করে মোট ১১ জনকে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাজে দায়িত্ব দেয়া হয়। আর তৎকালীন উপাচার্য মিজানউদ্দিন প্রশাসনের আনুকূল্য পেয়ে প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থই আত্মসাৎ করেন টিপু এমন অভিযোগ তদন্তে ওঠে এসেছে।

তদন্তের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত শিক্ষক টিপু যেসব কাগজ-পত্র জমা দিয়েছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে। যে কারণে ফের অধিকতর তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। আর টিপু তার নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ধামাচাপা দিতেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে ক্যাম্পাসে প্রচার রয়েছে।

উপাচার্য আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামীপন্থী আরেক শিক্ষক ড. সফিকুন্নবী সামাদি। তিনি সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মিজানউদ্দিনের সময় গ্রন্থাগার প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক সামাদীর বিরুদ্ধেও নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে।

সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মিজানউদ্দিনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৩ কোটি ২৯ লাখ ৪১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। মূলত, বিশ্বব্যাংক ‘হেকেপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে এই অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। এ সময় গ্রন্থাগারে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদি।

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ড. সামাদি দায়িত্ব পালনকালে গ্রন্থাকার কমিটির ৬টি, গ্রন্থাগার উপ-কমিটির ১০টি এবং গ্রন্থাগারের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বিষয়ে ৫২টি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোনো সভাতেই প্রকল্প বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য রেজুলেশনভুক্ত করা হয়নি। এসব সভার যথার্থতা, উপস্থিতি এবং ব্যয় নিয়েও নানা অসঙ্গতি ওঠে এসেছে।

অভিযোগ ওঠেছে টেন্ডার আহ্বান নিয়েও। টেন্ডারের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ড. সামাদীর কক্ষেই। নিজে ব্যবহারের জন্য প্রকল্পের ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় একটি ল্যাপটপ এবং ২২ হাজার টাকায় মাইক্রোসফট অফিস লাইসেন্স ক্রয় করেছেন, যা এখতিয়ার বহির্ভূত। প্রকল্পের টাকায় ট্রেনিংয়ের নাম করে ১২ লাখ টাকা খরচ করে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছেন চারজন। আরএফআইড ট্যাগ কেনার নাম করে ২০ লাখ টাকা গায়েব করেছেন, যার কোনো হিসাব মিলছে না।

ড. সামাদি প্রকল্পের অর্থে ৫ হাজার এবং ৬ হাজার টাকা দিয়ে দু’টি কলম ক্রয় করেন নিজে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু সে কলম কোন ব্যান্ড্রের অথবা এমন কলমের কার্যকারিতা কী, তারও কোনো তথ্য মেলেনি তদন্তে। ডাটা এন্টির কাজের জন্য ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ব্যয় করা মাত্র ২১ লাখ টাকা। অথচ এটিই ছিল প্রকল্পের গুরত্বপূর্ণ খাত। ডাটা এন্ট্রি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে গ্রন্থাগারের দায়িত্বে বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের করা তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করতে উচ্চআদালতে রিটও করেন সামাদি। মূলত, নিজের করা দুর্নীতি আড়াল করতেই অধ্যাপক সামাদি উপাচার্য সোবহানবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকেই।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক উপাচার্য মিজানপন্থী শিক্ষকরা মাঠে নেমেছেন আরেকটি দুর্নীতির ঘটনাকে চাপা দিতে। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন ঢাকায় জমিসহ ১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকায় রাবির অতিথি ভবন ক্রয় করে। এতে জমির মূল্য ১১ কোটি এবং ভবন নির্মাণ ব্যয় দুই কোটি ধরা হয়।

তবে টেন্ডার ছাড়াই কেনা ওই জমির মূল দলিলে জমির মূল্য সাড়ে ৩ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে ১১ কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে অনুমোদন করা হয়। দলিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন করা অর্থে ৮ কোটি টাকার গড়মিল ধরা পড়ে।

বিষয়টি নিয়ে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় রাবির উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোলাম কবিরকে প্রধান করে তিন সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তদন্ত করে জমি ক্রয়ে ৮ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পায়। পরে তা প্রতিবেদন আকারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জমা দেয়।

একই সাথে হাইকোর্টের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) অভিযোগ তদন্ত শুরু করে। এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সবিস্তারে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে দুদক তদন্তে অগ্রসর হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠেছে।

রাবি উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান বলেন, ‘আমার বিরদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত আহ্বান করেছি। কারণ উইজিসির তদন্তটি একপেশে। এতে আমার আস্থা নেই। আর যারা মিথ্যা অভিযোগ এনে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাদের উদ্দেশ্য সবার কাছেই পরিষ্কার। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করতে চাইছে তারা। তা পারবে না। জাতির কাছে সব উম্মেচিত হবে।

আন্দোলনের অভিযোগ নিয়ে অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম টিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একটি কমিটির মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় নিজে কমিটির মাধ্যমে এটা করেছে। আমি কন্টাকটার ছিলাম না, চুক্তিবদ্ধ লোকও ছিলাম না। তাহলে এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়। কিন্তু তথ্যবিহীনভাবে আমাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন করানো হয়েছে।

আরেক অভিযুক্ত শিক্ষক সফিকুন্নবী সামাদির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এসএমএস দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

  • 27
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে