শিক্ষার্থীদের স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীর শাহ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২০; সময়: ৬:২৪ অপরাহ্ণ |
শিক্ষার্থীদের স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীর শাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক : শিক্ষকরা যখন ক্লাসে পড়ানো বাদ দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যাচে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং পড়ানোর দিকে ঝুঁকছেন তখন জাহাঙ্গীর আলম শাহ নিরবে-নিভৃতে শিক্ষার্থীদের স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের স্ব-শিক্ষায় গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের একমাত্র সামাজিক বিজ্ঞান ল্যাব।

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে স্থাপিত এই ল্যাবে শিক্ষার্থীরা বইয়ের পঠিত বিষয়গুলো হাতে কলমে শিক্ষা নিতে পারেন। বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞান, কৃষি শিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষার বিষয়গুলো শিক্ষা দিতেই এ অভিনব ল্যাবের প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।

যেখানে শিক্ষার্থীদের দলবদ্ধভাবে গ্রুপভিত্তিক শিক্ষা নিতে হয়। এই ল্যাবে প্রবেশ করতেও হয় শৃঙ্খলার সাথে সারিবদ্ধভাবে।

করোনা ভাইরাসের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শুধু এই প্রতিবেদককে দেখানোর জন্য নওগাঁর মান্দার কালিগ্রামের গ্রামের বাড়ি থেকে শুক্রবার সকালে ছুটে আসেন তিনি।

শুক্রবার সকালে কলেজিয়েট স্কুলের গিয়ে তার ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, ল্যাবের চতুর্দিকে শিক্ষার্থীদের আঁকানো নানা ধরনের কাগজের পোষ্টারে ভর্তি। সেখানে সারি সারিভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীদের কাজ। কোনোটাতে হাতে কলমে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্র, কোনো পোস্টারে আঁকা রয়েছে একক ও যৌথ পরিবারের চিত্র, কোনোটা আঁকা হয়েছে ভাষার বিবর্তনের চিত্র, কোনোটা লেখা হয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে গাছপালা ও মাটি-ক্ষয়ের প্রভাব। চিত্রে আঁকানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব উপাদন ও পরিবেশের ক্ষতিকর উপাদন। ল্যাবে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে ভূমিকম্পের ফলে পুরো বাংলাদেশের কেমন চিত্র হবে মাটি দিয়ে সেসব তুলে ধরা হয়েছে এবং পরিচ্ছন্ন ও অপরিচ্ছন্ন শহরের চিত্রও তৈরি করা হয়েছে।

জাহা্ঙ্গীর শাহের সামাজিক বিজ্ঞান ল্যাবের চিত্র

জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, ২০০৮ সালে ল্যাবটি তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার বাইরে বের করে এনে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এই ল্যাবটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানও যে একটি বিজ্ঞান তা এই ল্যাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শেখানো হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল হিসেবে গড়ে তোলা, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা এবং হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এই ল্যাবটি তৈরি করা হয়েছে। এই ল্যাবের মাধ্যমে পঠিত পাঠ্যপুস্তুকের যে বিষয়গুলো তোতাপাখির মতো মু্খস্ত করে শিক্ষার্থীরা তা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যখন একজন শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে একক পরিবার ও যৌথ পরিবার সম্পর্কে পড়ে তখন তার চিত্র মানসপটে ভেসে উঠে না। যখন শিক্ষার্থীরা তা নিজে থেকে হাতে কলমে গ্রুপভিত্তিক এঁকে দেখায় তখন তা মানসপটে ভেসে উঠে। এছাড়া ভূমিকম্পের ফলে কী অবস্থা তৈরি হতে পারে তা-ও শিক্ষার্থীরা মাটি দিয়ে তৈরি করে দেখায় তখন তার বাস্তব জ্ঞান ও চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি হয়।

জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, একজন শিক্ষকের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীর লাটিম ঘুরিয়ে দেওয়া, তার পর সেই ঠিক করে নেবো তাকে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি সেই কাজটিই করার চেষ্টা করছি। শ্রেণিকক্ষে কেন শিক্ষকরা সবসময় কথা বলবেন, শিক্ষার্থীদেরই তো বেশি কথা বলতে দেওয়া উচিত। আমি শিক্ষার্থীদের বেশি কথা বলতে দিই। আমি অ্যাসাইনমেন্ট দিলে তাদের গ্রুপ অনুযায়ী কাজটি করে। তার জন্য যে কার্ডবোর্ড পেপার ও কলমের দরকার হয় সেসব তারা নিজেরাই চাঁদা তুলে কিনে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাবলম্বী ও শৃঙ্খলার মনোভাব তৈরি হয়। একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ ঘটে।

রাজশাহী কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে জাহাঙ্গীর আলম শাহ ১৯৯১ সালে পাবনা জিলা স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় আসেন। এরপর রাজশাহী হাজী মুহম্মদ মহসিন উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে বর্তমানে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

শিক্ষকতা পেশায় আসার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও এই পেশায় আসার পর তার মনে হয়েছে, তিনি সঠিক পেশায় বেছে নিয়েছেন। শিক্ষকতা শুরুর পর থেকেই তিনি সবসময় ভেবেছেন কীভাবে শিক্ষার্থীদের যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত।কিভাবে চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

এইজন্য সবসময় পাঠদানের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তিনি।

তিনি নিজেও মনে করেন, পাঠদান একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতি যার যত ভালো, বিজ্ঞানসম্মত, তিনি তত ভালো শিক্ষক। এইজন্য কখনোই কোচিং সেন্টারে ক্লাশ নেওয়া বা প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা পয়সা ইনকামের চিন্তা করেন নি। কোচিং সেন্টারে ক্লাশ নিয়ে টাকা ইনকামকে তিনি অনৈতিক মনে করেন। সবসময় বিনা পয়সায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন।

জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, যেসব শিক্ষার্থী নিজে থেকে চিন্তা করে পড়ালেখা করে তাদের দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে। ক্লাসে মুখস্ত করতে না পারার জন্য হয়তোবা ক্লাশে ফাস্ট হতে পারে না কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে।

অন্য শিক্ষকদের মতো গতানুগতিক পদ্ধতিতে নিজ কক্ষে পাঠদান না দিয়ে ব্যতিক্রমি এক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ব্যবস্থা করায় শুরুতে অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক বিষয়টি ভালো চোখে দেখেন নি। সবসময় আড়ালে আবডালে বিরুদ্ধাচারণ করেছেন তারা। কিন্তু যখন শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ ফল পেতে আরম্ভ করলো তখন শিক্ষক ও অভিভাবকরা তা মেনেও নিয়েছেন।

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের রসায়ন বিভাগের সহকারী শিক্ষক আব্দুর রশিদ সরদার জানান, স্যার সবসময় ভিন্ন পদ্ধতিে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান। যা শিক্ষার্থীদের মননশীল হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। অনেক নিন্দা ও গালমন্দ সয়েও স্যার তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব সহিদুল ইসলাম ল্যাবটি পরিদর্শন করে পরিদর্শন খাতায় লিখেছেন, শিক্ষা গ্রহণে এমন কার্যকর পদ্ধতি সব জায়গায় প্রয়োগ করা গেলে পুরো সমাজের চিত্রই বদলে যাবে। জীবনমুখী এমন শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি সবজায়গায় কার্যকর হোক এমনটাই প্রত্যাশা।

সামাজিক বিজ্ঞান ল্যাবে শিক্ষার্থীদের একাংশ

শুধু সামাজিক বিজ্ঞান ল্যাবই তৈরি করেননি,২০০৮ সালে নওগাঁর মান্দার কালিগ্রামে প্রতিষ্ঠ করেছেন কৃষক উপযোগী বাংলাদেশ একমাত্র কৃষি লাইব্রেরি ও জাদুঘর। জাদুঘরে দুইশবছর আগের কৃষকদের ব্যবহৃত কৃষি উপকরণ রয়েছে। কৃষি লাইব্রেরিতে রয়েছে কৃষি নিয়ে লেখা বিভিন্ন মূল্যবান বই। জাহাঙ্গীর শাহ নিজেই ‘কৃষি পঞ্জিকা’ নামের এক মূল্যবান বই লিখেছেন। এই করোনা ভাইরাসে সময়ে ‘শেকড়’, ‘চাষীর কথা’, ‘খাবারে বিষের ছোবল’ নামে তিনটা বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করেছেন।

এছাড়া তার বাড়িতে ২৫০টি ওষুধি গাছ ও ৪৪টি ফলের গাছও লাগিয়েছেন। কাজ করেন পরিবেশ ও বিষমুক্ত খাবার নিয়ে।

কৃষি লাইব্রেরি ও জাদুঘর দেখতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে করোনাকালীন পূর্বে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা ভিড় করতেন। প্রতিদিন গড়ে একশ থেকে দেড়শো মানুষ তার এই কৃষি লাইব্রেরি ও জাদুঘর পরিদর্শন করতে আসেন। এছাড়া এলাকার ৭৫ জন শিক্ষার্থীকে লাইব্রেরির পাশের কক্ষে বিনামূল্যে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এছাড়া কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান তাদের বিনাখরচে থাকার ব্যবস্থা করেছেন এই জাদুঘরের পাশে। এই কৃষি লাইব্রেরিতেই একমাত্র কৃষি কবিতার চর্চা হয়। দেশ বিদেশের নানা গুণীজনের পদধূলি পেয়েছে তার কৃষি লাইব্রেরি ও জাদুঘর। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদক থেকে অসংখ্য পদক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে শিক্ষক হওয়াতেই গর্ববোধ করেন জাহাঙ্গীর শাহ।

জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, আমার অনেক শিক্ষার্থী আমার চেয়ে ১০ গুণ বেতন বেশি পান। কিন্তু সেসব নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। যেসব কাজ করি সেখান থেকে কোনো অর্থ উপার্জন করতে না পারলেও আত্মসন্তুষ্টির ব্যাপার আছে। আমি যেকাজ করতে চাই সেই কাজ করতে পেরেই আমি সন্তুষ্ট। এই কাজগুলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ন্যূনতম কাজে লাগলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের না আসার কারণ হিসেবে জাহাঙ্গীর শাহ মনে করেন, এইজন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র যদি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের বেতনন ভাতা বাড়িয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেন তখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা এমনিতেই এ পেশায় আসবে। বেতন ভাতা কম থাকার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসছে না বলে মনে করেন তিনি।

এ পেশাকে আধুনিকায়নের সাথে সাথে বেতনভাতা বৃদ্ধি করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কে বিষয়ে জাহাঙ্গীর শাহ মনে করেন, সব সম্পর্কই ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। তাছাড়া ঠিক সেইভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীরা না আসায় এই পেশার মর্যাদা অনেকটা কমে গেছে। সমাজে মর্যাদা নির্ধারণ হয় তার পদমর্যাদা দিয়ে।

ব্যক্তিজীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা জাহাঙ্গীর শাহ। বড় মেয়ে নাটোরের বাউয়েট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা শেষ করেছেন। ছেলে ভারতের কেরালায় স্কলারশীপ নিয়ে একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন।

জাহাঙ্গীর শাহ ইচ্ছা, কোনো না কোনো ফরম্যাটে তার ছেলেমেয়েরা শিক্ষকতা পেশায় আসবে এমনটাই মনে করেন তিনি। না এলেও তার কোনো দুঃখ নেই। ভালো মানুষ হয়ে যে পেশায় থাকুক না কেন সৎ থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা তার।

 

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে