আষাঢ়ে নিস্তেজ টিএসসি

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২০; সময়: ৫:১৮ অপরাহ্ণ |
আষাঢ়ে নিস্তেজ টিএসসি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : কখনো আকাশে ধূসর কালো মেঘ, কখনো বিরামহীন বৃষ্টি ধারা, আবার কখনো ঝড়ের প্রবল তাণ্ডব। প্রকৃতির এই নানা রঙ-রূপ-মাদকতা নিয়েই প্রকৃতিতে আসে বর্ষা। বাঙালি মননে নিয়ে আসে রোমান্টিকতা-আধ্যাত্মিকতার এক মধুর সুর। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলটি থাকে প্রিয়জনের নামে।

প্রতিবছরই পহেলা আষাঢ়ের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জড়ো হয় নানা বৈশিষ্ট্যের মানুষ, বন্ধু, বান্ধবী কিংবা প্রিয়জনদের সঙ্গে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিরাজ করে এক অন্যরকম আমেজ। কিন্তু করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে এবারের এই বর্ষার আগমণী দিবসে টিএসসি পাবে না তার নিত্যকার রূপ। ফাঁকা পড়ে থাকবে পুরো এলাকা। যেখানে আষাঢ়ের রোমান্টিকতায় টিএসসি থাকে এক ভিন্নরূপে রাঙানো সেখানে জায়গা করে নিয়েছে নিথর নিস্তব্ধতা।

গ্রীষ্মের রুদ্র প্রকৃতির গ্লানিকে ধুয়ে মুছে প্রশান্তি, স্নিগ্ধতা আর সবুজে ভরে তোলে স্বতন্ত্র এই ঋতুটি। বর্ষায় সব গ্লানি ধুয়ে মুছে গিয়ে হাসি-আনন্দ, আর ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠে পুরো প্রকৃতি।

বর্ষাকে বরণ করে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় প্রতিবছরই আয়োজিত হয় বর্ষা উৎসব। সেই উৎসবের সেই আমেজের বদলে এবার থাকবে শুধুই নিরবতা।

এদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতি সাজে অপরূপ মহিমায়। অন্যান্য বছর তরুণ তরুণীরা টিএসসি প্রাঙ্গণে যন্ত্র সংগীত, নৃত্য, সংগীত আর বন্ধুদের গান আড্ডায় মেতে উঠতো সেখানে থাকবে করুণ নিষ্ঠুর বাকরূদ্ধ দীর্ঘশ্বাস। সমস্ত হিসেব বদলে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।

বৃষ্টির ভেতর দাড়িয়ে প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে টিএসসির চায়ের দোকানে চা-এ চুমুক দিতে দিতে বর্ষাকে উপভোগ করা আর হলো না এবার। হলো না, টিএসসিতে এসে গোল হয়ে বসে গান করা আর পরক্ষণেই সবাই মিলে টিএসসির মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে আনন্দের সেই মুহূর্তগুলোকে কাছে পাওয়া।

প্রাণঘাতী মহামারি করোনা প্রতিদিনই দেশ জুড়ে তার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, একইসাথে চির অচেনায় হারিয়ে যাচ্ছে অনেকের প্রিয় মানুষের মুখগুলো। এমন এক নিদারুণ পরিস্থিতিতে কাটছে সকলেরই দিন।

প্রতিবছর আনন্দে কাটানো এই দিনটির অভাববোধ কাজ করছে অনেকের মনে। আনন্দ আর ভালোবাসায় বর্ষার আগমণী বার্তা নিয়ে আসা পহেলা আষাঢ়কে মিস করছেন তারা। অনুভূতি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, কতটা মিস করছি এই দিনটিকে তা সংক্ষেপে বলা খুবই কঠিন। তবে টিএসসিতে ফুল বিক্রি করা ছোট্ট মেয়ে বৈশাখীর হাতের কদম ফুলের ছুটাছুটি মিস করছি! ফুল নিয়ে দৌড়ে এসে হাতে একটা কদম ধরিয়ে দিত, সেই কদম আবার আমি পৌঁছে দিতাম প্রিয়জনের কাছে। বর্ষার শুরুটা এমনই হয়। বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে স্বপন মামার লাল চা আর হালকা ভিজতে ভিজতে প্রিয়তমা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, কিংবা অডিটোরিয়ামের সামনে বসে বৃষ্টি দেখা! এসব স্মৃতি এইবছর কষ্ট দিলেও প্রত্যাশা করছি বর্ষা যেমন প্রতিবছর ভ্যাপসা গরম তুলে নিয়ে যায় দূর আকাশে, কদম ফুলের মিষ্টি গন্ধে মুখরিত করে চারপাশ এবছর হইতো বর্ষা ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে করোনার বিষ, ফিরে দিবে নির্মল সুস্থ বাংলাদেশ, কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে পৃথিবী! নিঃশ্বাস নিবো করোনা মুক্ত নির্মল বাতাসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহেদ কবির বলেন, প্রকৃতি থেমে নেই, থেমে গেছি আমরা। বর্ষা এলেই যেন প্রকৃতি নব বধূর সাজে নতুন ভাবে সজ্জিত হয়। বর্ষার প্রকৃতি এবারও ব্যতিক্রম নয়, যদিও মানুষের আচার অনুষ্ঠান সহ স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়ে আছে। বর্ষার সৌন্দর্য শুধু প্রকৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রতিটি হৃদয়ে রোমান্টিকতার ছোঁয়া দিয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, অন্যান্য বছরের মতো সকল উচ্ছ্বসিত প্রাণ গুলো একত্রে নেই। সবাই অদৃশ্য এক ভাইরাসের কাছে পরাজিত হয়ে বন্দী জীবনযাপন করছে। এবারের বর্ষা বরণে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি না হলেও খুঁজে পেয়েছি বাল্যবেলার দুরন্তপনার বৃষ্টির দিনগুলো। অদৃশ্য ভাইরাসের থাবার হাত থেকে ফিরে আসুক পৃথিবী, বর্ষা প্রকৃতির ফুলের মতো ফুঠে উঠুক পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ। বর্ষার বৃষ্টিতে ধুয়ে যাক সকল যন্ত্রণা, রাগ, অভিমান, হারানোর ব্যথা।

সকল কিছুর উর্ধ্বে থাকা এই জীবনকে নিরাপদ রাখতে ও নিজের প্রিয়জনের সুস্থতার দিকে নজর রেখে সবাইকে ঘরে থাকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। কেননা কথায় আছে, কোনো প্রশ্নে যদি প্রিয় মানুষকে হারানোর সম্ভাবনা শতকরা এক শতাংশও থাকে তবে তার উত্তর ‘না’ খোঁজাই জীবনের সবচেয়ে স্বার্থক সিদ্ধান্ত। আজ দিনে মনে পড়ে যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আষাঢ় কবিতাটি। যেখানে তিনি বলেন, নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে, তিল ঠাঁই আর নাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। বাদলের ধারা ঝরে ঝর-ঝর, আউশের খেত জলে ভর-ভর, কালী-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্‌ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

কোনো একদিন আবারও সবকিছু কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে, শিশুরা মাঠে খেলবে, তরুণ-তরুণী আড্ডায় মাতবে। বর্ষার আনন্দ আবার ভাগাভাগি করে নিতে পারবে সকলেই। এখন শুধুই অপেক্ষা সেই রঙিন ভোরের যেদিন উঠে পৃথিবীর সবকিছুকে আবার স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারবো।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে