কান্তকবি রজনীকান্ত সেন

প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২০; সময়: ২:১২ অপরাহ্ণ |
কান্তকবি রজনীকান্ত সেন

মুস্তাফিজুর রহমান খান : “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই। দ্বীন-দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশী আর সাধ্য নেই।”

ব্রিটিশ শাসনামলে বিদেশী পণ্য বর্জনের লক্ষ্যে রচিত কালজয়ী গান এর মাধ্যমে পরিচিতি যার, তিনি রাজশাহীর আইনজীবী কবি রজনীকান্ত সেন। বাংলার পঞ্চকবির অন্যতম কান্তকবি রজনীকান্ত সেন পেশায় ছিলেন আইনজীবী। রাজশাহীর আদালতে ওকালতি করেন এবং বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন অন্যত্র।

কবি ওকালতি পছন্দ করতেন না। ওকালতিকে তিনি অমানবিক ও মনুষ্যত্বহীন পেশা হিসাবে মনে করতেন। সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন থাকার কারণে মক্কেলদের যথোপযুক্ত সময় দিতে পারতেন না। তবে সেজন্য মনোকষ্ট ভোগ করতেন।

পঞ্চকবি তৃতীয় রত্ন ছিলেন আইনজীবী কবি রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০)। অপরাপর কবিরত্নবৃন্দ হলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বীজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।

বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের অন্যতম সাধক কবি ও গীতিকার রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ জুলাই (১২৭২ বঙ্গাব্দের ১২ শ্রাবণ) বুধবার প্রত্যুষে পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) অন্তর্গত বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং কালব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর (১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্র) মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটায় কোলকাতা মেেিকল কলেজ হাসপাতালের ১২ নম্বর কটেজ-এ পরলোক গমন করেন। কবির পিতার নাম শ্রীযুক্ত গুরু প্রসাদ সেন ও মাতার নাম শ্রীমতী মনোমহিনী দেবী। শ্রী গুরু প্রসাদ সেন ছিলেন সাবজজ, লেখক ও সুগায়ক। কবির পিতৃজ্যেষ্ঠ শ্রীযুক্ত গোবিন্দনাথ সেন ছিলেন রাজশাহীর বিখ্যাত উকিল, ধনবান ও দানশীল ব্যক্তি।

পিতামাতার তৃতীয় সন্তান কবি রজনীকান্ত সেন -এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল রাজশাহীতে। শিশুকালে তিনি রাজশাহীর বোয়ালিয়া জেলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) ভর্তি হন। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিকুলেশন বা মাধ্যমিক) পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজে এফ.এ (ফাষ্ট আর্টস বা উচ্চ মাধ্যমিক) ক্লাসে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে (১২৯১ বঙ্গাব্দ) দ্বিতীয় বিভাগে এফ.এ পাস করেন। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে কোলকাতা সিটি কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে ঐ একই কলেজ থেকে বি.এল পাস করে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন। কবি সব সময় সাহিত্য নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তাই তিনি ওকালতিতে তাঁর পূর্বসুরীদের মতো খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। আবার তাঁদের মতো অঢেল টাকাও আয় করতে পারেননি তিনি।

‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত কবি রজনীকান্ত সেন পেশায় ছিলেন আইনজীবী। রাজশাহীতে ওকালতি করতেন। আর এই ওকালতির পাশাপাশি করেছেন সাহিত্য- গান রচনা। তাঁর কবিতা ও গানের ভাষা সহজ-সরল হলেও তাতে রয়েছে গভীর দেশপ্রেম, দিক নির্দেশনা ও উপদেশ। যা মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ ও ঈশ^রের প্রতি গভীর ভক্তি-কৃতজ্ঞতা সৃষ্টি করে। আবার সকলকে দায়িত্বশীল ও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণা দেয়। মোট কথা- দেশ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে কবি রজনীকান্তের গান ও কবিতার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এখন আমাদের দেশে তাঁর সাহিত্যের তেমন চর্চা নেই।

তাঁর রচিত গানগুলো ‘কান্তগীতি’ নামে পরিচিত। তিনি তাঁর স্বরচিত গানের সুকণ্ঠ গায়কও ছিলেন। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে তিনি রচনা করেছেন ৮টি মূল্যবান গ্রন্থ এবং প্রায় আড়াই শত গান। এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থ- বাণী, কল্যাণী ও অমৃত প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পূর্বে এবং বাকি পাঁচটি- আনন্দময়ী, বিশ্রাম, অভয়া, সম্ভাব-কুসুম ও শেষ দান প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পরে। এসব গানের মধ্যে নিম্নের গানটি স্বদেশী আন্দোলনকালে সমগ্র বাঙলায় সবচেয়ে বেশী আলোড়ন সৃষ্টি করে।

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তু’লে নে রে ভাই;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সুতোর সঙ্গে, মায়ের
অপার স্নেহ দেখ্তে পাই;
আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ
পরের দোরে ভিক্ষা চাই।
ঐ দুঃখী মায়ের ঘরে, তোদের
সবার প্রচুর অন্ন নাই;
তবু, তাই বেচে, কাঁচ, সাবান, মোজা,
কিনে কল্লি ঘর বোঝাই।
আয় রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা কর্’ব ভাই,-
পরের জিনিস কিন্বো না, যদি
মা’য়ের ঘরের জিনিস পাই।

ব্রিটিশ শাসনামলে বিদেশী পণ্য বর্জনের লক্ষ্যে কবি রজনীকান্ত এ গানটি রচনা করেন। বিদেশী পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ওই সময় কোলকাতায় অনেকে গান লিখেছিলেন, কিন্তু রজনীকান্তের গান সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। স্বদেশী আন্দোলনের যুবকর্মী-শিক্ষার্থীরা কোলকাতার রাস্তায় মিছিল করে তাঁর গান গাইতে শুরু করলেন। যার ফলে স্বদেশী আন্দোলন-কর্মসূচী আরো বেগবান হয়ে উঠলো। এতে রাজশাহীর কবি রজনীকান্তের যশ-খ্যাতি সারা বাঙলায় ছড়িয়ে পড়লো। এরই সাথে আমাদের ছোট্ট শহর রাজশাহী (তৎকালে রাজসাহী) ভারতবর্ষে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। বিষয়টি অজানা ছিল না পঞ্চকবির শেষ রত্ন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তাই তিনি ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে রাজশাহী এসে রজনীকান্তের তাঁর বসতবাড়ি ‘আনন্দ নিকেতন’ (বাড়ীটির নাম ‘আনন্দ নিকেতন’) পরিদর্শন করেন এবং বাড়ীটি স্পর্শ করে শ্রদ্ধাভরে বলেছিলেন, ‘প্রাচীন যুগের স্বদেশী গানের স্রষ্টা, গীতিকার, সুরকার, আপনি আজও গানের মাঝে অমর হয়ে আছেন, আপনাকে নমস্কার।’

মূলতঃ ঐতিহাসিক ওই স্বদেশী গানটি রচনার জন্যই কবি নজরুল তাঁর অগ্রজ কবি রজনীকান্তকে নমষ্কার জানিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন রাজশাহী শহরের ‘সাহেব বাজারের’ তাঁর একতলা বাড়িটির সামনে এসে। অবশ্য বর্তমান শিক্ষানগরী রাজশাহীর মানুষ প্রাচীন কবি রজনীকান্তকে কিংবা তাঁর বাড়ী চেনেন না। আর না চেনার কারণেই তাঁর বাড়ীটি সংরক্ষণ না করে বরং এটি ময়লা-আর্জনায় পুঁতে ফেলা হয়েছে। আবর্জনার মধ্যে কোনমতে টিকে থাকা এই ঐতিহাসিক প্রাচীন বাড়ীটি এখন সোনালী ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে বাড়ীটি ভেঙ্গে ফেলার চিন্তাভাবনা চলছে। এক সময় সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হয়তো বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলবে, সেখানে গড়ে উঠবে বিশল অট্টালিকা। আর এভাবেই প্রাচীন কবি রজনীকান্তের শেষ স্মৃতিচিহ্নটি হারিয়ে যাবে রাজশাহীর স্মৃতিপট থেকে এবং তিনিও হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের অতল গহ্বরে।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর তিনি কোলকাতা হাসপাতালে ভীষণ দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। তিনি হয়ে যান নির্বাক। কিন্তু এতে ঈশ^রভক্তি তাঁর হ্রাস পায়নি বরং আরও বেড়েছে। রোগের যন্ত্রণা যত গভীর হয়েছে, সাধকের ন্যায় ঐশী করুণাকে তিনি ততই নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরেছেন। কোন অভিমান না করে শেষ জীবনের দুঃসহ বিপর্যয়কেও তিনি ঈশ^রের দয়ারূপে গণ্য করেছেন এবং সেই বোধকেই রূপায়িত করে নির্বাক অবস্থায় অস্তিমশয্যায় বসে লিখেছেন-

আগুন জে¦লে, মন পুড়িয়ে
দেয় গো পাপের খাদ উড়িয়ে;
ঝেড়ে ময়লা মাটী, ক’রে খাঁটি
স্থান দেয় অভয় শ্রীচরণে।

সম্প্রতি ২০১৯ সালের মধ্যভাগে রাজশাহীতে “রজনীকান্ত সেন পরিষদ” নামে একটি সংগঠনের গোড়া পত্তন হয়েছে। কবির কাব্য চর্চা ও সমৃতি সংরক্ষণের জন্য কিছু উদ্যোগের কথা বললেও এখন সরীসৃপের ন্যায় গভীর শীতঘুমে নিমগ্ন সেই পরিষদ।

রাজশাহীতে রজনীকান্ত সেন এর স্মৃতি সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবী। কবি রজনীকান্ত সেন এর বসতবাটির সামনে সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন করা হোক। যেমন আমরা দেখেছি কলকাতায় বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে স্থাপিত স্মৃতি ফলক। তাছাড়াও জিরোপয়েন্ট থেকে পদ্মা পাড়ের সাংস্কৃতিক ও বিনোদন কেন্দ্র পর্যন্ত সড়ক কবি রজীকান্ত সেন এর নামে করা যেতে পারে। যা কবির ঐতিহাসিক বসতবাটির পাশ দিয়ে গেছে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, এডভোকেট ও সাংবাদিক।

  • 24
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে