গুরুদাসপুরের নারী সহায়তা কেন্দ্র বদলে দিয়েছে অসহায় নারীদের জীবনের গল্প

প্রকাশিত: মে ২৩, ২০২২; সময়: ৯:১০ অপরাহ্ণ |
গুরুদাসপুরের নারী সহায়তা কেন্দ্র বদলে দিয়েছে অসহায় নারীদের জীবনের গল্প

নবীউর রহমান পিপলু, নাটোর : নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসনের ‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’ বদলে দিয়েছে দরিদ্র পরিবারের অসহায় নারীদের জীবন চিত্র। উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অহসায় নারীদের গল্পগুলো এখন একেবারের অন্যরকম। প্রায় আড়াই বছর আগে চালু হওয়া এই কেন্দ্রটি সারা দেশের মধ্যে এধরনের একমাত্র সেবা কেন্দ্র। এ্ি কেন্দ্র থেকে সহায়তা নিয়ে অনেকেই সাবলম্বি হয়েছেন।

সুবিধাভোগী নারীরা কল্পনাও করেননি যে, তারা নিজেরা সাবলম্বি হবেন। নানা সমস্যা থেকে দ্রুত সমাধান করতে পারবেন। এই সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে বাল্য বিয়ে থেকে রক্ষা পেয়েছেন বেশ কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থী। এরা এখন আবারও লেখা পড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। গুরুদাসপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত অসহায় নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা, নির্যাতিত নারীদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা, দুঃস্থ মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসনের ‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’।

বলা যায় উপজেলার অতি দরিদ্র পরিবারের অসহায় নারীদের আস্থার প্রতীক এখন‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তমাল হোসেন গ্রামের অসহায় নারীদের কথা চিন্তা করে এই ‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’ চালু করেন।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়, ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর উপজেলা প্রশাসনের একটি কক্ষে এই ‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’ চালু করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহারিয়াজ কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উপজেলার বিভিন্ন সেবা প্রকল্পের (সিটিজেন চার্টার)একটি এটি। প্রতিষ্ঠার আড়াই বছরে এই কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার নারী বিধবা ভাতা, বয়ষ্ক ভাতা, স্বামী পরিত্যাক্তা ভাতা, পঙ্গু ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, সেলাই মেশিন প্রাপ্তি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, চিকিৎসা ও পড়াশোনার জন্য আর্থিক সহায়তা, সৌর বিদ্যুৎ, টিউবওয়েল, মিটারের আবেদন, ভিজিডি কার্ড,দুঃস্থ্য মহিলাদের ক্ষদ্র ঋণ প্রদানসহ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সহায়তা পেয়েছেন।

শুরুতে সকলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আবেদনের জন্য কোর্ট ফ্রির ২০ টাকা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এরপরেেথকে আবেদন ফরমের রাজস্ব স্ট্যাম্পের ২০ টাকা সেবাগ্রহীতাদের দিয়ে আবেদন করতে হয়।

উপজেলা প্রশাসনের ডিজিটাল সেন্টারের নারী উদ্যোক্তা বেলি খাতুন বলেন, নারী সহায়তা কেন্দ্রে শতভাগ সেবা নিশ্চিত করার জন্যে ডিজিটাল সেন্টারের কাজের পাশাপাশি তিনি নারী সেবা কেন্দ্রের কাজ করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা বয়স্ক নারী ও শিশুদের জন্য রয়েছে বসার ব্যবস্থা। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন নারী বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সেবা কেন্দ্রে আসেন। অসহায় নারীদের বিভিন্ন অভিযোগ শুনে আবেদন আকারে লিপিবদ্ধ করেন তিনি।

প্রতিষ্ঠার শুরুতে প্রতিটি আবেদন ফরম ফ্রি করে দেওয়া হলেও এখন স্ট্যাম্প ফি বাবদ ২০ টাকা করে নেওয়া হয়। প্রতিদিন অফিস সময় শেষে সকল আবেদনের কপি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা দেওয়া হয় । উপজেলা নির্বাহী অফিসার ( ইউএনও) মোঃ তমাল হোসেন প্রতিটি আবেদন গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। গত আড়াই বছরে ‘নারী সহায়তা কেন্দ্রে’ চিকিৎসা ও পড়াশোনার জন্য আর্থিক সহযোগিতার আবেদন করেছেন প্রায় ৪০০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতন ইভটিজিং প্রতিরোধে প্রায় ১০০০ জন, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, স্বামী পরিত্যাক্তা ভাতা, পঙ্গু ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা প্রায় ১২০০ জন, সেলাই মেশিন ও মাতৃত্বকালীন ভাতা ৩০০ প্রায় জন, সৌর বিদ্যুৎ,টিউবওয়েল,মিটারের আবেদনে ৫০ জন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ৫০জন সহ ভিজিডি কার্ডধার দেরও আবেদন রয়েছে।

এসব আবেদন নেয়ার পর সরেজমিন গিয়ে প্রায় সকল নারী সেবা গ্রহিতার সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। এই ‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’ চালু হওয়ার পর থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আবেদনে সেবা পেয়েছেন ৩০ জন, নির্যাতিত ৪ জন নারীকে দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ ও পুর্নবাসন। সেবা কেন্দ্রে আবেদন করায় বন্ধ হয়েছে ৫০ জন স্কুল ছাত্রীর বাল্যবিয়ের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন জন শিক্ষার্থীকে সাহসিকতার পুরুষ্কারও দেওয়া হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়া প্রতিটি ছাত্রী বর্তমানে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া এই সেবা কেন্দ্রের উদ্দ্যোগ ও পদক্ষেপে উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের পারভীন বেগম ও মশিন্দা ইউনিয়নের মশিন্দা পশ্চিমপাড়া এলাকার স্বর্ণা বেগমের শিশু উদ্ধার করে তাদের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন নিজের বাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন তারা।

গুরুদাসপুর শহরের স্বামী পরিত্যক্তা পাপিয়া বেগম জানান,তিনি নারী সহায়তা কেন্দ্রে সেলাই মেশিনের জন্য আবেদন করে সেলাই মেশিন পেয়েছেন। এক সময় অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কেটেছে। এখন তিনি সেলাই মেশিনের কাজের টাকায় সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।

উপজেলার মশিন্দা গ্রামের রুখসানা বেগম জানান, নারী সহায়তা কেন্দ্র তার জীবনের গল্প বদলে দিয়েছে। কর্মহীন স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো তাদের। ধার দেনা ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে যে আয় হতো তাদিয়েই কোনভাবে দিন গেছে। এখন নারী সহায়তা কেন্দ্র থেকে সেলাই মেশিন পেয়ে তাদের এখন ভালভাবেই দিন কাটছে। মা মেয়ে দুজনায় ওই মেসিন চালিয়ে উপার্যন করছি। তাদের মা মেয়ের উপার্জিত আয়ে সংসারে স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করেছে। আরো একটি সেলাই মেসিন পেলে তাদের আয় আরো বেশী হতো।

নারী সহায়তা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ তমাল হোসেন বলেন,জনগন ও প্রশাসনের মধ্যেকার দুরত্ব কমিয়ে এনে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করে নতুন নতুন উদ্ভাবনীর মাধ্যমে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে তরান্বিত ও টেকসই করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আসহায় নারীরা যেন সহজে সেবা পায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই সেবা কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছে। গুরুদাসপুর উপজেলায় চালুকৃত এই নারী সহায়তা কেন্দ্রটি দেশের মধ্যে এধরনের একমাত্র সেবা কেন্দ্র।

সেবা প্রাপ্তি সহজিকরন ও সেবা প্রদান পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনায়নসহ গ্রামের অসহায় নারীদের শতভাগ সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই নারী সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়। অসহায় নারীরা নির্বিঘ্নে এই সেবা কেন্দ্রে আবেদন করতে পারেন। আবেদন পাওয়ার পরপরই গুরুত্বসহকারে সরেজমিন গিয়ে তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা হয়। স্বল্প সময়ে অনেক নারী এখানে আবেদন করেছেন। অনেকেই এর সুফল ভোগ করে স্বাভাবিক জীবন-যাপন শুরু করেছেন। এই সেবা কেন্দ্রের সহায়তা নিয়ে অনেকেই তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে