কুমিল্লায় সংঘর্ষে নিহত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুলের বাড়িতে শোকের মাতম

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২১; সময়: ৯:০৬ অপরাহ্ণ |
কুমিল্লায় সংঘর্ষে নিহত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুলের বাড়িতে শোকের মাতম

ডি এম কপোত নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের বাগডাঙ্গা মধ্যপাড়া গ্রামের শামসুল হকের ছেলে মো. বাবুল (৩০) কুমিল্লা জেলার হাজীগঞ্জে রাজমিস্ত্রী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে।

কুমিল্লার একটি মন্দিরে কোরআন অবমাননার অভিযোগে সৃষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়। এই তিনজনের একজন বাবুল। বুধবার বাদ এশার হাজীগঞ্জ বাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

নিহতের পরিবার, সাথে থাকা শ্রমিক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মোজাফফর হোসেন জানান, গত বুধবার সন্ধ্যায় হাজীগঞ্জ বাজারে লক্ষ্মীনারায়ণ জিওর আখড়া মন্দিরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শটগানের গুলি ছোড়ে।

এ সময় মন্দিরের পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন ভবনের ৭ম তলায় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয় রাজমিস্ত্রী বাবুল। পরে তার সাথে থাকা অন্যান্য শ্রমিকরা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

হাজীগঞ্জে নিহত বাবুলের সাথে থাকা আরেক শ্রমিক ও তার চাচাতো ভাই মোশাররফ হোসেন মুঠোফোনে পদ্মা টাইমস কে বলেন, বাবুলের অধীনে ১০ জন রাজমিস্ত্রী ও শ্রমিক কাজ করতো। এমনকি সেও রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। বুধবার সন্ধ্যার পর কাজ থেকে ফিরে এসে গোসল করে জানালার পাশে বসে ছিল।

পরে হঠাৎ করে আনুমানিক রাত সাড়ে আটটার দিকে বাম চোখে গুলি লাগে। পরে আমরা উঠিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে নিহত বাবুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা আসছে বাবুলের বাড়িতে। তার মা, বাবা, স্ত্রী, দুই মেয়েসহ স্বজনরা কান্নার রোল পড়েছে। স্বজনদের আহাজারি ও মাতমে পরিবেশ শোকাবহ হয়েছে বাগডাঙ্গা মধ্যপাড়া গ্রামের বাবুলের বাড়ি।

দূর দুরান্ত থেকে দেখতে আসছে আত্মীয় স্বজনরা। বেলা ৩টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে লাশবাহী গাড়ি রওনা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুপুর পর্যন্ত চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার মরদেহ রাখা হয়েছিল।

নিহত বাবুলের মা রেজিয়া বেগম বলেন, ছেলে গত ৩ বছর ধরে হাজীগঞ্জে কাজ করে। কালকে রাতে শুনতে পেলাম ওখানে নাকি পুলিশের সাথে গোলাগুলি হয়েছে এবং আমার ছেলে মারা গেছে। ছেলেকে তো পাব না, তাই এখন লাশের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু লাশটাও নাকি আনতে দিচ্ছিল না। অনেক ঝামেলা করেছে।

রাজমিস্ত্রী বাবুলের স্ত্রী এখনও মানতে পারছেন না তার স্বামী বেঁচে নেই। বড় মেয়ে সুমাইয়া (১০) ও ফাতেমা (০৫) নিয়ে কি করবে কিভাবে সংসার চালাবে এই চিন্তায় কয়েকবার অজ্ঞান হয়েছেন। কাঁদতে থাকা বাবুলের স্ত্রীকে শান্তনা দিচ্ছেন আত্মীয় স্বজনরা। কিন্তু স্বামী হারিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।

বাবুলের সহধর্মিণী জানান, বৃহস্পতিবার ২ মাস পূর্ণ হলো হাজীগঞ্জ যাওয়া। ২ মাস পর লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। তার অবদানেই সংসার চলে। সে চলে গেল। দুটি মেয়েকে নিয়ে কিভাবে থাকবো, কিভাবে বাঁচবো কিছুই জানি না বলে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

বাবুলের বাবা শামসুল হক বলেন, ছেলের লাশ নিয়ে আসা হলেই কবর খোঁড়া হবে। সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছি দু’ইটি মেয়েকে নিয়ে। তাদের কি হবে, কোথায় থাকবে কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রতিবেশী মো. মাসুদ রানা জানান, বাবুলের সাথে আমাদের এলাকার আরও অনেক মিস্ত্রী ও লেবার ওখানে একসাথে কাজ করে। গোসল করে রুমে অনেকেই একসাথে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে জানালা দিয়ে গুলি এসে তার বাম চোখে আঘাত করে। এতেই তার মৃত্যু হয়েছে। তাদের পরিবার খুব অসহায়। তাদেরকে সহায়তা করার জন্য সরকার ও প্রশাসনকে অনুরোধ জানায়।

স্থানীয় বাসিন্দা ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, তারা খুবই অসহায় পরিবার। বাবুল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। সে চলে যাওয়ার পর তারা খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেল। একজন নিরপরাধ মানুষ, অথচ পুলিশের গুলিতে মারা গেল। প্রশাসনের কাছে এই পরিবারটির পাশে দাঁড়াবার অনুরোধ করছি গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে।

সন্ধ্যায় সুন্দরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান জানান, হাজীগঞ্জ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে লাশ রওনা দিয়েছে। লাশ আসলে দাফনের ব্যবস্থা করা হব। সার্বক্ষণিক পরিবারটির সাথে যোগাযোগ রাখছি। বাবুলের পরিবারকে সরকারি বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের জন্য চেষ্টা করছি।

সূধী মহলসহ এলাকাবাসীর জোর দাবি দুই শিশুসহ নিহত বাবুলের পরিবারকে সরকার ভোরণ পোষণ ও পরিবার চালানোর জন্য যাতে ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। নাতো ভিক্ষা করা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নিহত রাজমিস্ত্রী বাবুল। রাজমিস্ত্রীর কাজ করেই চলত গোটা পরিবার। তার আকস্মিক মৃত্যু তে ঘোর অন্ধকার নেমে আসলো পুরো পরিবারটির উপর।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে