রেডিও আনোয়ার : রেডিও যার ধ্যান-জ্ঞান

প্রকাশিত: মে ৭, ২০২১; সময়: ৯:৪৯ অপরাহ্ণ |
রেডিও আনোয়ার : রেডিও যার ধ্যান-জ্ঞান

আরিফুল হক সোহাগ, নওগাঁ : বর্তমান ডিজিটাল সময়ে শব্দ তরঙ্গের ব্যবহার হাতের মোবাইল ফোন বা নানা প্রকারের ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে শব্দ তরঙ্গের ব্যবহার রেডিও বা ট্যানজিস্টার নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেছিল। অত্যাধুনিক যুগে এসেও নওগাঁর আনোয়ার হোসেন এখনও নিয়মিত রেডিওতে অনুষ্ঠানমালা শুনে থাকেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বে রেডিও (বেতার) এর ব্যবহার শুরু হলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বেতারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আর বর্তমান সময় এসেও সেই রেডিও বা ট্যানজিস্টারকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন এই রেডিও পাগল মানুষ।

নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার পরানপুর ইউনিয়নের বানিসর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। যিনি কি না রেডিও আনোয়ার নামে সবার কাছে পরিচিত। ১০ বছর বয়সে তার মা তাকে প্রথম রেডিও কিনে দেন। সেই থেকে নিয়মিত রেডিওতে অনুষ্ঠানমালা শোনেন তিনি। গেল ৪০ বছরে ২৭টি রেডিও ব্যবহার করেছেন তিনি।

এগুলোর মধ্যে মাত্র ৩টি রেডিও তিনি সংগ্রহ করেছেন দোকান থেকে। বাকি রেডিওগুলো আর্থিক অভাবে এবং সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যাওয়ার কারনে দূরদূরান্ত থেকে ব্যবহৃত পুরোনো রেডিও ভাঙ্গারি দোকান থেকে অথবা কেউ পুরাতন রেডিও বিক্রি করলে সেখান থেকে সংগ্রহ করেছেন তিনি।

রেডিও প্রেমী এই মানুষ জানান, মোবাইলে গান শুনতে তার ভালো লাগে না। আর রেডিওতে গান, সংবাদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুনতে পাওয়া যায়। অভাব অনটনের সংসারে নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়েও রেডিওকে কোনদিন ছাড়েন নি এই মানুষ।

লোকালয়ে রেডিও শোনার ফলে কারও সমস্যা তৈরি হলে নিজে একমনে রেডিও ঘাড়ে করে চলে যান নিরালয়ে। বর্তমানে রেডিওতে কোন সমস্যা দেখা দিলে নিজেই এর সমাধান করতে পারেন আনোয়ার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রেডিও ব্যবহার করে যেতে চান বলে জানান এই রেডিও পাগল মানুষ।

এদিকে স্বামীর রেডিও নিয়ে সংসারের উদাসীনতায় অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার পরিচালনা করছেন তার স্ত্রী আমেনা বেগম। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন শাশুড়ি ও স্বামীকে নিয়ে তিনজনের সংসার চালাতে হয় তাকে। অনেক কষ্টে দিন যায় বলে জানান তিনি।

আমেনা বেগম বলেন, তিনি সবসময় রেডিও নিয়ে থাকেন। মাসের মধ্যে ১০ দিন সংসারের কাজ করে যে উপার্জন করেন তা দিয়ে রেডিও মেরামত এবং নিজের খরচ করে শেষ করেন। আর শারিরিক সমস্যা থাকায় বেশিক্ষণ ধরে কাজও করতে পারেন না তিনি।

আনোয়ারের রেডিও প্রীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, একদিন সংসারে চাল, ডাল, তেল, নুন কিছুই ছিল না। তিনি কাজ করে ফিরে এসে দেখেন, আনোয়ার রেডিও নিয়ে পড়ে আছেন। রাগে-দুঃখে রেডিও ভেঙ্গে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর আনোয়ার বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যান। এক মাস পর আনোয়ার ২টা রেডিও কিনে বাড়ি ফেরেন। তারপর থেকে রেডিও নিয়ে আর কোন সময় রাগারাগি করেননি আমেনা বেগম। অভাব অনটন ছাড়া রেডিও পাগল এই মানুষকে নিয়ে ভালোই আছেন তিনি। সরকারে দেওয়া ১০ টাকা কেজির চাল ছাড়া কোন সহায়তা পান না বলে জানান তিনি।

এদিকে আনোয়ারের এমন রেডিও শোনাকে বেশ ভালোভাবে উপভোগ করেন এলাকাবাসি। তারা জানান, বর্তমান সময়ে এসেও আনোয়ার রেডিওর ব্যবহার ধরে রেখেছেন এটা সত্যিই বিস্ময়কর। এখনকার ছোট ছেলেমেয়েরা মোবাইল ফোন ডিভাইসে বিভিন্ন ধরনের গেমস খেলায় ব্যস্ত থাকে। এতে করে তাদের চোখের বা ব্রেইনের ক্ষতি হয়ে থাকে। রেডিও পরিচিতি বা ব্যবহার যদি তারা দেখতে বা শুনতে পায় তবে শিশুরাও ঝুঁকিমুক্ত বিনোদন উপভোগ করতে পারবে বলে মনে করেন তারা।

এলাকার সাধারণ মানুষরা জানান, সবসময় মানুষের মন একরকম থাকে না। যদি রেডিও শুনতে কোন সমস্যা হয় তবে আনোয়ারকে বললে তিনি নিরালয়ে রেডিও নিয়ে চলে যান। রেডিও শোনা নিয়ে আনোয়ারের সাথে কোনদিন কারও ঝগড়া বিবাদ হয়নি বলে জানান তারা।

এদিকে রেডিওর ব্যবহার ধরে রাখার জন্য রেডিও আনোয়ারকে ধন্যবাদ দিয়ে বাংলাদেশ বেতারের নওগাঁ প্রতিনিধি এ্যাডভোকেট শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে ডিভাইসগুলো আধুনিক হয়ে যাওয়ার কারনে রেডিও বা ট্যানজিস্টারের ব্যবহার আর চোখে পড়ে না। উনবিংশ শতাব্দীতে এর ব্যবহার ব্যাপকতা ছাড়ালেও বর্তমানে এটিকে যাদুঘরে রাখার মত অবস্থা। এই শিল্পটাকে ধরে রাখতে রেডিও আনোয়ারের মত মানুষের পাশে সবসময় থাকা উচিত বলে জানান তিনি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইলিয়াস খান জানান, আনোয়ার ছোটকাল থেকে রেডিওতে অনুষ্ঠানমালা শুনে আসছেন। এলাকার সবাই তাকে রেডিও আনোয়ার নামেই চেনেন। তার পরিবারকে ইতোমধ্যে সরকার কর্তৃক ১০ টাকা কেজির চাল প্রদান করা হচ্ছে। পরবর্তীতে তার পরিবারকে বিভিন্ন ভাতার আওতায় নিয়ে এসে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের আশ্বাস দেন তিনি।
রেডিও বা ট্যানজিস্টারের ব্যবহার বর্তমানে নেই বললেই চলে। উনবিংশ শতাব্দীর এই শব্দ তরঙ্গের ব্যবহারের মাধ্যমেকে ধরে বেঁচে থাকার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নওগাঁর রেডিও আনোয়ার।

  • 163
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে