তবে কী ভেড়ার লোমের তৈরি কম্বলের ঐতিহ্য হারিয়েই যাবে?

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১; সময়: ৭:২৭ অপরাহ্ণ |
তবে কী ভেড়ার লোমের তৈরি কম্বলের ঐতিহ্য হারিয়েই যাবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশেষ ধরনের কাঁচির সাহায্যে ভেড়ার লোম কেটে বিভিন্ন রঙের লোম থেকে একই রঙের লোম আলাদা করে পানিতে ভালো করে ধোয়া হয়। এরপর তা শুকিয়ে ধুনাই করে তুলা করা হয়। সেই তুলা চরকায় কেটে তৈরি করা হয় সুতা। তারপর সেই সুতা হস্তচালিত তাঁতে বুনে তৈরি করা হয় কম্বল। তৈরিকৃত কম্বল আবার বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়।
ভেড়ার লোমের তৈরি কম্বল বেশ গরম হওয়ায় শীত নিবারণে তা খুবই কার্যকরী।
আর এই কম্বল তৈরির কাজটিই করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়াগোলা মহল্লার ৬৫ বছর বয়সি আব্দুল খালেক। তার কম্বলের চাহিদা নামকরা বিপণিবিতান থেকে দেশব্যাপি। তার দাবি, সারা দেশে একমাত্র তিনিই ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি করে থাকেন।

তবে পৈত্রিকভাবে পাওয়া এই পেশা তিনি ধরে রাখলেও তার সন্তানরা কেউ এই পেশায় না আসায় তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তার মৃত্যুর পর হয়তো এই পেশায় আর কাউকে পাওয়া যাবে না।

আব্দুল খালেক জানান, তারা বংশ পরম্পরায় ভেড়ার লোম কাটেন। এর আগে তার দাদা, দাদার বাবা, তার নিজের বাবা এই পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। এইজন্য তাদেরকে গাড়লী বলা হয়। তিনিও খুবই ছোটবেলা থেকেই এই পেশার সাথে যুক্ত। তখন থেকে অবধি তিনি এই পেশার সাথে যুক্ত আছেন। সে হিসেবে তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে এই পেশার সাথে যুক্ত আছেন। তবে তার দুই ছেলের কেউ এই পেশার সাথে যুক্ত নাই। বড় ছেলের পুরাতন বইয়ের ব্যবসা করে এবং ছোট ছেলে মোটর মেকানিক ও তেলবাহী লরীর চালক।

আব্দুল খালেক জানান, আমি গ্রীষ্মের সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে কাঁচির সাহায্যে ভেড়ার লোম কাটি। এইজন্য প্রতিটি ভেড়ার শরীরের লোম কেটে দেওয়ার জন্য ৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। কেউ কেউ ভেড়ার লোম কেটে দেওয়ার জন্য ১০০ টাকা করেও দিয়েছেন। আগে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টি ভেড়ার লোম কাটতে পারলেও এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় ২০ থেকে ৩০টির বেশি ভেড়ার লোম কাটতে পারেন না। অনেক সময় সরকারি আহ্বানে প্রাণি সম্পদ দফতরে লালনপালনকৃত ভেড়ার লোমও কেটে দিয়ে আসেন। লোম কাটার পর সেই লোমই সংগ্রহ করে তিনি কম্বল তৈরি করেন।

আব্দুল খালেক জানান, এই শীতেও মাত্র দেড় মাসে তিনি ২০টি কম্বল তৈরি করে বিক্রি করেছেন। প্রতিটি কম্বল বিক্রি করেছে তিন হাজার টাকা করে। একটি কম্বল তৈরি করতে তার পাঁচদিন লাগে।

আব্দুল খালেক জানান, একটি কম্বল তৈরি করতে ১২টি ভেড়ার লোম লাগে। ১২ টি ভেড়া থেকে চার কেজি লোম পাওয়া যায়। সেই লোম পানিতে ধুয়ে শুকানো হলে দুই কেজি লোম পাওয়া যায়। সেই দুই কেজি লোম ধুনে তুলা তৈরি করা হয়। সেই তুলা চরকায় কেটে সুতা তৈরি করা হয়। তারপর সেই সুতা হস্তচালিত তাঁতে বুনে কম্বল তৈরি করা হয়। একটি কম্বল সাধারণত সোয়া তিন হাত চওড়া ও পাঁচ হাত লম্বা হয়।

আব্দুল খালেক জানান, তাঁতে কম্বল বুননের পর সেটা গরম পানিতে সাড়ে তিন ঘণ্টা ভিজিয়ে পা দিয়ে খোঁচাখুঁচি ও টানাটানি করতে হয়। এরপর রোদে শুকাতে হয়। তারপর তা ব্যবহার উপযোগী হয়। কারণ গরম পানিতে ভিজিয়ে শুকানো হলে সুতাগুলো বেশি টাইট হয় এবং কম্বলের বাইরের লোমগুলো ঝরে পড়ে যায়। আব্দুল খালেক জানান, শুরুতে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁ এলাকায় ফেরি করে কম্বল বিক্রি করতাম। ভেড়ার লোমের কম্বল হওয়ায় চাহিদাও ছিলো প্রচুর। কারণ ওই এলাকায় প্রচুর ঠান্ডা পড়তো আর ভেড়ার তৈরি কম্বল খুব গরম দেয়। তাই ওই অঞ্চলের মানুষ বেশি কিনতো। তখন প্রতিমাস কম্বল আড়াইশো টাকা করেও বিক্রি করেছি। এরপর ধীরে আড়ং, অরণ্য ও হ্যান্ড টাচের কাছে প্রচুর কম্বল বিক্রি করেছি। এছাড়া দেশের বিভিন্নস্থানে লোকজন আমার তৈরি কম্বল কিনে ব্যবহার করছেন।

আব্দুল খালেক জানান, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেড়ার লোম কাটার জন্য একবার দুই মাস থাকতে হয়েছিলো। তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। আমি সেই ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি করে শেখ সাহবকে ( শেখ মুজিবুর রহমানকে) দিয়েছিলাম।

আব্দুল খালেক জানান, বংশ পরম্পরায় এই পেশা চলে আসলেও আমার পূর্বপুরুষ তেমন নকশা জানতো না। আমি বিভিন্ন ধরনের নকশা শিখেছিলাম আমার গুরু সীতেশ বাবুর কাছ থেকে। তিনি রাজশাহী শহরের ভেড়ীপাড়া এলাকায় থাকতেন। তিনিও মারা গেছেন।

আব্দুল খালেক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এই পেশায় আর কেউ থাকলো না। আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় আমিও তেমন কাজ করতে পারিনা। এই শিল্পকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। প্রাণীসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়নচন্দ্রকে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছিলাম। যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেও কাউকে শেখানো যেত।

আব্দুল খালেক জানান, আমার তৈরি কম্বল ঢাকার হ্যান্ড টাচের সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়াতেও গেছে। সেখান থেকে আমাকে ডিজাইন পাঠিয়ে তৈরির কথাও বলা হয়েছিলো কিন্তু শরীর না কুলাতে আর তৈরি করতে পারিনি। ১১ ফেব্রুয়ারি তার তৈরিকৃত কম্বল দেখিয়ে আব্দুল খালেক বলেন, এই কম্বল প্রাণ কোম্পানির এক কর্মকর্তা এক মাস আগে অর্ডার দিয়েছিলেন।

এবছর শীতে তিনটি কম্বল ক্রয় করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত আরিফুল ইসলাম। কম্বল তিনটি ক্রয় করে একটি পাঠিয়েছে দিনাজপুরের একটি চিকিৎসকের বাসায় আর দুইটি পাঠিয়েছেন তার কোম্পানির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার কাছে। আরিফুল ইসলাম জানান, তাদের কাছে ভেড়ার লোম থেকে কম্বল তৈরির গল্প বলাতে তারা অর্ডার দিয়েছিলেন। তারা এখন ভালোভাবেই ব্যবহার করছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় ভেড়ার খামার বেশি থাকায় আব্দুল খালেকের জন্য ভালো হয়েছে। তার পক্ষে অনেক কম্বল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখন বয়েস হয়ে যাওয়ায় খুব একটা তৈরি করতে পারেন না। শুধু অর্ডারের কাজগুলোই করেন।

আব্দুল খালেকের তৈরি ভেড়ার লোমের কম্বল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রাণীসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দকেও উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরির ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা সম্ভব হলে তা খুবই ভালো হত। কারণ ভেড়ার লোমের তৈরি কম্বল খুব গরম হওয়ায় শীত নিবারণে খুবই কার্যকরী। এজন্য শীতপ্রধান দেশে এই কম্বলের যথেচ্ছ ব্যবহার আছে। তবে আব্দুল খালেকের আফসোস রয়ে গেছে তার সন্তানদের কেউ এই পেশায় না আসায় তারপর আর কেউ এই পেশায় রইলো না।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে