বদলগাছীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর আজও সংস্কার হয়নি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২০; সময়: ৪:১১ অপরাহ্ণ |
বদলগাছীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর আজও সংস্কার হয়নি

নিজস্ব প্রতিবেদক, বদলগাছী : দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছরেও নওগাঁর বদলগাছীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অরক্ষিত গণ কবরটি আজও কোন সংস্কার করা হয়নি। আর এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে গ্রামবাসী। সংস্কার ও সংরক্ষনের অভাবে ভূমিক্ষয় ও ধ্বসের কারনে অরক্ষিত গণ কবর এর স্থানটি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।

ঐ গণকবরে শায়িত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা বদলগাছী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে থাকলেও গণকবরটির হেফাজত করা হচ্ছেনা। উপজেলা পরিষদ, স্থানীয় প্রশাসন ও জেলা পরিষদ লাখ লাখ টাকার বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়ন মূলক কাজ করলেও এই গণকবরটি সংস্কারের প্রদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে প্রর্তক্ষ্যদর্শী ডাঙ্গিসারা গ্রামের মোঃ আস্তুল আলী (৭৫), লুৎফর রহমান (৭০) , আব্দুস সামাদ ও ওসমান আলী জানান, ঐ দিন দুপুরের পর একজন ব্যক্তি ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় ছোট যুমুনা নদী পাড় হয়ে আমাদের এই ডাঙ্গিসারা গ্রামে আসে এবং গ্রামবাসীর সাহায্য চায় এবং সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

ওই মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন তারা মোট ছিলেন ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। সকলের বাড়ী নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায়। বেঁচে যাওয়া ঐ মুক্তিযোদ্ধা আরো জানায় ৯ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে তাঁরা ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে যায়। কারণ তাঁরা ৩ জন ছিল ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।

আর ঐ ৩ জন প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আরো ৬ জনকে সঙ্গে নিয়ে বদলগাছীর উপরদিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে ঐদিন সকালে বদলগাছীর বালুভরা ইউপির মির্জাপুর মোড়ে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সন্ধেহে আটক করে কতিপয় রাজাকারেরা। আটকের পর পাক-হানাদার বাহিনীর নিকট তাঁদেরকে হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তর করার পর নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে আধাইপুর ইউপির সেনপাড়া গ্রামের জঙ্গলে শাড়িবদ্ধ ভাবে তাদের চোখ বেঁধে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলিকরে । আর গুলির শব্দ পেয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ৩ মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা চিৎ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কৌশল করে প্রাণে বেঁচে যায়।

আর বাঁকী ৬জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বেঁচে যাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হাতের বাঁধন খুলে ঐদিন দুপুরের পর ছোট যমুনা নদী পার হয়ে ডাঙ্গিসারা গ্রামে গিয়ে উঠে। এসময় সে দেখতে পায় তাঁর আরও একজন সঙ্গি ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়ে নদীতে এসে পানি খাচ্ছে। বেগতিক অবস্থার মধ্যে স্থানীয় লোকজন ঐ ২ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তাঁদের নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। বেঁচে যাওয়া ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিজ গতিতে প্রাণে বেঁচে ফিরে যায় তাঁর নিজ বাড়িতে। বাঁকী ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসে তাঁদের স্বজনরা এই ডাঙ্গিসারা গ্রামে। স্বজনরা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় নিহত ৬ মুক্তিযোদ্ধার ক্ষত-বিক্ষত লাশ ও হাড় গোড় উদ্ধার করে এনে ডাঙ্গিসারা গ্রামের ছোট যমুনা নদীর ধারে গন কবর দেয়।

ঐ গ্রামের শিক্ষক সুরেশ সিংহ বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গণ কবরসহ মসলমানদের কবরস্থান হিসেবে আমার পিতা রাম জনম সিংহ সাড়ে ১৬ শতক জমি কবরস্থানের নামে রের্কড করে দিয়েছেন।

এলাকাবাসীরা জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের গণ কবর সংরক্ষন ও বাঊন্ডারী ওয়াল নির্মাণের জন্য বহুবার উপজেলা নির্বহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় এমপি মহোদয়ের নিকট ধর্না দেওয়া হয়েছে কিন্তু কিন্তু তাঁরা এই গনকবরটি সংস্কারের কোন ব্যবস্থা করেননি। মুক্তিযুদ্ধে আত্বত্যাগী ৬ মুক্তি যোদ্ধার প্রান কেড়েনিল পাক হানাদার বাহিনী। আর যারা এই দেশ স্বাধীনের জন্য প্রান দিয়েছে সেই ৬ আত্মত্যাগী শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণ কবরটি সংস্কারের অভাবে অরিক্ষত অবস্থায় ভুমিক্ষয় ও ধ্বসের কারনে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে ।

ডাঙ্গিসারা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শি সহ গ্রামবাসী জানান, তাঁরা নিজ হাতে প্রানে বেঁচে যাওয়া ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছে। এবং যে ৬ জন মারা গিয়েছে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে কবরস্থ করেছে। স্বজনরা মান্দা উপজেলা থেকে এসে এখানে বহুবার মিলাদ মাহাফিলও করেছেন।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুত্রে জানাযায়, গণকবরে স্বায়িত ৬ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ময়নম ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামের মৃত, করিম সোনারের ছেলে কাদের বক্্র, মৃত, কওছর আলী মন্ডলের ছেলে শাকায়েত মন্ডল, মৃত, মকা আকন্দর ছেলে ইয়াজ উদ্দীন আকন্দ, মৃত, লইম উদ্দীন মন্ডলের ছেলে লৎফর রহমান মন্ডল, প্রসাদপুর ইউনিয়নের মৃত শশি মন্ডলের ছেলে মোহাম্মদ আলী খোকা, গনেশপুর ইউনিয়নের মৃত, মাদার উদ্দীন এর ছেলে বিরাজ উদ্দীন এবং প্রানে বেঁচে যাওয়া ৩ জন মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ময়নম ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামের মৃত, মীর মোল্লার ছেলে মোঃ নজরুল মোল্লা, মৃত, কলিমুদ্দীন মন্ডলের ছেলে নিকবর মন্ডল, মৃত খয়রুল মন্ডলের ছেলে গছির উদ্দীন মন্ডল।

দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছরেও এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো হয়নি। বর্তমান মুক্তিযোদ্ধাদের গনকবরটি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। তাই এই সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে জরুরী ভিত্তিতে গন কবরস্থানটি সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। ঐ গ্রামের যুবক এমদাদুল হক ভুটু জানান, গন কবর সংরক্ষনের জন্য বারবার ইউএনও ও এমপি বরাবরে আবেদন জানালেও কোন ফল হয়নি।

এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোঃ জবীর উদ্দীন জনান, উপজেলার ১১টি গণ কবরের তালিকায় বদলগাছী সদর ইউনিয়নের ডাঙ্গিসারা গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণ কবরস্থানটির নাম রয়েছে এবং এ তালিকা উপজেলা নির্বহী অফিসারের কার্যালয়ে জমা দেওয়া আছে। এই গন কবরটি সংস্কারের জন্য উপজেলার বিভিন্ন মিটিংএ বারবার বলা হলেও আজও সংস্কারের কোন ব্যবস্থা করেননি প্রশাসন।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাঃ আবু তাহির এর সংগে কথা বললে তিনি বলেন, আমি এই গণ কবরটি সর্ম্পকে জানিনা । তবে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা করা হবে।

এলাকার সচেতন মহল বলেন, সরকারি লক্ষ লক্ষ টাকা বিভিন্ন খাতে বরাদ্ধ থাকলেও এই গন কবরটি সংস্কার এর জন্য কনো বরাদ্ধ করা হয়না। আর এ কারনে ঐ গন কবরে স্বায়িত ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তাদের সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ।

তারা আরো বলেন, যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ তাঁদেও গন কবরটিরই সংস্কার নেই। তাই এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে এই গন কবরটি সংস্কার এর জন্য উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্শন করেছে সচেতন মহল ।

 

 

  • 73
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে