পাবনায় ইউএনও লাঞ্ছিতর ঘটনায় পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২০; সময়: ৭:০৬ অপরাহ্ণ |
পাবনায় ইউএনও লাঞ্ছিতর ঘটনায় পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, পাবনা : স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় থেকে পাবনা বেড়া পৌরসভার বরখাস্ত হওয়া মেয়র আব্দুল বাতেনের বিরুদ্ধে বেড়া থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বুধবার রাতে ইউএনও আসিফ আনাম সিদ্দিকী নিজে বাদী হয়ে বেড়া মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১১।

বেড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কাশেম মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সরকারী কাজে বাধা প্রদান, হুমকি এবং এবং ইউএনও আসিফ আনাম সিদ্দিকীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় পেনাল কোডের ৩২৩, ৩৩২, ৩৫৩, ৩৫৫ ও ৫০৬ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় ঘটনার দিনে উপস্থিত তিনজন জনপ্রতিনিধিকে সাক্ষী করা হয়েছে । তবে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে নাই।

এদিকে ইউএনও কে লাঞ্ছিত করায় গত মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় পাবনার বেড়া পৌরসভার মেয়র আব্দুল বাতেনকে মেয়র পদ থেকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে মিটিংয়ের মধ্যে লাঞ্ছিত করেছেন। যা স্থানীয় সরকার আইন ও শৃঙ্খলা পরিপস্থী। এর আগে তাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে এবং পরে বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে বহিস্কার করা হয়।

কে এই আব্দুল বাতেন:- এলাকায় প্রতাপশালী এক ব্যক্তি, যিনি বিভিন্ন সময়ে দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীত দমন কমিশনে তিনটি মামলা বিচারাধীন। ২০১৫ সালের একটি এবং ২০১৬ সালের দুটি মামলা এখন বিচারাধীন। মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে বেশ কিছুদিন হাজত খেটে এখন জামিনে আছেন। দুদকের পাবনা অঞ্চলিক কার্যালযের উপ-পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন জানান বাতের বিরুদ্ধে চলমান তিনটি মামলাই ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের। অতি সম্প্রতি এক ইউপি এক চেয়ারম্যান এর চাল চুরির ঘটনায় তার পক্ষে তদবির করায় দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জেলা আওয়ামী লীগ তাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সহ সকল পদ থেকে অব্যাহতি দেয়।

পাবনার বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা গ্রামের জুড়ান সরদারের পুত্র আব্দুল বাতেন ছিলেন রিক্সা শ্রমিকদের নেতা। ১৯৮৪ সালে আব্দুল বাতেন যোগদান করেন জাতীয় পার্টিতে। তখনকার জাতীয় পর্টির নেতা পাবনা-১ এর সংসদ সদস্য মেজর (অবঃ) মঞ্জুর কাদেরের (সাবেক ত্রাণ ও পূনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী এবং পানি উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী) ছিল তার সখ্য। এরশাদ সরকারের পতনের পর আব্দুল বাতেন ১৯৯১ এর নির্বাচনের সময় যোগদান করেন জামায়াতে ইসলামীতে। এই বছরের নির্বাচনে এবং এর পর ১৯৯৬ এবং ২০০১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আব্দুল বাতেন ছিলেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী (পাবনা-১) এজেন্ট। প্রতিটি নির্বাচনে তিনি নিজমীর সঙ্গে জনসভায় অংশগ্রহণ করে বক্তৃতা করেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি ছিলেন সাঁথিয়া-বেড়া এলাকায় নিজামীর অন্যতম সহচর।

২০০৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে (পাবনা-১) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আব্দুল বাতেনের সহোদর শামসুল হক টুকু। উল্লেখ্য ১৯৯৬ এর নির্বাচনে জয়ী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী) আওয়ামী লীগের সংস্কার পস্থী হওয়ায় দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন। শামসুল হক টুকু জয়ী হওয়ার পর প্রথমে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এবং পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পদ পান।

ভাই টুকু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওযার পর থেকেই বাতেনের কপাল খুলে যায়। তিনি ক্রমান্বয়ে বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি পদটি দখল করেন। নিবেদিতপ্রাণ সিনিয়র নেতাদের ডিঙিয়ে তিনি হন দলের উপজেলা সভাপতি।

দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন আব্দুল বাতেন। তার কথায় চলতো থানা পুলিশ। সাঁথিয়া-বেড়া এলাকায় সকল দরবার শালিশের নেতৃত্ব দিতেন আব্দুল বাতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্ব্যবহারই তার হাতিয়ার ছিল। এরই ধারবাহিকতায় সাধারণ মানুষ ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তাদের নাজেহাল এবং অপমান অপদস্ত করা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। বাতেনের বিরোধীতা করলে বা তার শালিশের কেউ বিরোধীতা করলে তাকে হয়রানী করা হতো মিথ্যা মামলা দিয়ে।

বাতেনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে জনমনে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পড়তেন চতুর্থ শ্রেণীতে। যদিও তিনি দাবি করেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা। শুধু তাই নয় জাতীয় পার্টির সরকারের সময় তিনি বেড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ছিলেন। তখন ‘ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বাতেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার’ শিরোনামে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছিল, উক্ত খবরের প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে। ২০০৮ সালের পর আবার তার নাম অন্তর্ভূক্ত হয় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
২০১৬ সালের প্রথম দিকে দুর্নীতির মামলায় হাজত বাস করেন আব্দুল বাতেন। দুদকের মামলা থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে অংশ নেন বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে। ২০১৮ এর ৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হন নৌকা প্রতীক নিয়ে।

দুর্নীতির মামলার একজন আসামী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায় তখন এলাকাবাসী অবাক হয়। নির্বাচনে জয়ী হয়ে আব্দুল বাতেন প্রভাব প্রতিপত্তি আরও বেড়ে যায়।

আব্দুল বাতেনের ঢাকায় কয়েকটি ফ্ল্যাট ও দেশের বাইরে মালয়েশিয়ায় রয়েছে সেকেন্ড হোম। পাবনা শহরের মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকায় রয়েছে তার জমি। বেড়া থানার পাশেই করেছেন বিশাল অট্টালিকা। এছাড়াও জমিজমা করেছেন অনেক। এলাকাবাসী তার সম্পদের হিসাব চায়।
পাবনা নির্বাচনী এলাকা-১ এর সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় আব্দুল বাতেন হচ্ছেন জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোশক। তার কারনেই এই এলাকায় এখনও জামায়াত-শিবির তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।

উল্লেখ্য, আব্দুল বাতেন গত সোমবার বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আনাম সিদ্দিকীকে উপজেলা পরিষদের মিটিংয়ে লাঞ্ছিত করলে গত মঙ্গলবার সরকার মেয়র আব্দুল বাতেনকে তার পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে।

বুধবার রাতে বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আনাম সিদ্দিকী বাদী হয়ে বেড়া থানায় আব্দুল বাতেনকে আসামী করে একটি মামলা দয়ের করেছেন। মামলার সাক্ষী করা হয়েছে তিনজন জনপ্রতিনিধিকে।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে