চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৭৩%, বিয়ে হচ্ছে গোপনে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২০; সময়: ৬:৪৯ অপরাহ্ণ |
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৭৩%, বিয়ে হচ্ছে গোপনে

কপোত নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাল্যবিয়ে নামক সামাজিক ব্যধির চিত্র ভয়াবহ। গোটা জেলাজুড়ে এই সামাজিক ব্যধির প্রকোপ থাকলেও চরাঞ্চলে আরও বেশি।

আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও গোপনে বাল্যবিয়ে হলেও বন্ধ করতে পারছে না প্রশাসন। দিন যতই যাচ্ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার ও প্রশাসনের নানা উদ্যোগ এবং সামাজিক প্রচার-প্রচারণাসহ কোনো কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না জেলার অধিকাংশ বাল্যবিয়ে।

আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশের বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি বিষয়ে ইউনিসেফের প্রকাশিত প্রতিবেদনেও এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এখন ৫১ শতাংশ। বাংলাদেশে জেলাগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চিত্র আরও ভয়াবহ। এ জেলায় বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৭৩%, যা সর্বোচ্চ। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতার অভাবে বিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। অনেকেই এর কারণ হিসেবে প্রশাসনের নজরদারিকে দায়ী করছেন।

এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ, প্রগ্রেস অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ শীর্ষক ইউনিসেফের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের বাল্যবিয়ের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। দেশের পুরো জনসংখ্যার মধ্যে ৩ কোটি ৮০ লাখ নারীর বাল্যবিয়ে (১৮ বছরের আগে বিয়ে) হয়েছে। এদের মধ্যে ১কোটি ৩০ লাখের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের আগে।

প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, বাল্যবিয়ের শিকার শিশুদের বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবারের ও গ্রামে বাস করে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অবিবাহিত মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। বিবাহিত প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রতি পাঁচজন ১৮ বছরের আগে ও প্রতি ৮ জন ২০ বছরের আগে সন্তান জন্ম দেয়। বাল্যবিয়ে কমানোর অগ্রগতি উচ্চবিত্ত ও ধনীশ্রেণির মধ্যে বেশি বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বাল্যবিয়ের পেছনে পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থানকে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে অনেক অভিভাবক বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছেন মেয়েদের। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, এটি সচেতনতার অভাব।

ফলে বাস্তবতা বুঝে ওঠার আগেই একে তো সংসারের দায়িত্ব, অন্যদিকে অকালে মা হচ্ছে এসব কম বয়সী মেয়ে। এতে নতুন করে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে তাদের। যে বয়সে হাতে বই থাকার কথা, সে বয়সে কোলজুড়ে আসছে সন্তান। কাঁধে স্কুল ব্যাগের বদলে সংসারের বোঝা। স্কুলের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে জেলার বিভিন্ন গ্রামের বহু কিশোরীকে।

শারীরিক বা মানসিক কোনও দিক থেকেই বিয়ের উপযুক্ত না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে পরিবার পরিকল্পনার কোনও ভূমিকা থাকে না। ফলে নানাবিধ যৌন রোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। বাল্যবিয়ের শিকার এসব মেয়ে গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবের সময়ে উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পায় না। ফলে তার ও শিশুর উভয়ের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. নাহিদ ইসলাম মুন জানান, অল্প বয়সে মেয়েরা সন্তান গর্ভে ধারণের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মায়েরা পিপিএইচ, কোলন লেবার, অবসট্রাক্ট লেবার ইত্যাদি সমস্যায় পড়ে। আবার প্রি-ম্যাচিউরড ডেলিভারির ফলে এদের সন্তানরা ভোগে লো-বার্থ ওয়েট সমস্যায়। তাছাড়া অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ে তারা। পূর্ণ মানসিক বিকাশের আগে মা হওয়ার কারণে সন্তানের দিকে সঠিক মনোযোগ তারা দিতে পারে না। ফলে অল্প বয়সী মায়ের সন্তানরা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না।

জেলা সদরের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে যে পরিমাণ ছাত্রী ভর্তি হয়, তার ৩০ ভাগ এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছায় না। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবগুলোরই বিয়ে হয়ে যায়। অবশ্য শহরের বিদ্যালয়গুলোয় এর পরিমাণ কিছুটা কম। এছাড়াও বিদ্যালয়েও মাধ্যমিক স্তরের শ্রেণিতেও কিছু কিছু বিবাহিত শিক্ষার্থী রয়েছে যা বাল্যবিয়ে প্রমাণ করে। মফস্বল উপজেলাগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পারছে না প্রশাসন কিংবা সামাজিক সংস্থাগুলো। এ ক্ষেত্রে বর-কনে পক্ষ নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে। কোনো কোনো বাল্যবিয়ে গোপন স্থানে এবং বাড়ির বাইরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আবার কোনো কোনো অভিভাবক ভুয়া জন্ম সনদও ব্যবহার করছেন। যার ফলে এ নিয়ে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাল্যবিয়ের খবর পেয়ে কখনো প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও অনেক বাবা-মা দু-একদিন পর বর-কনেকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বা অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন।

জেলার সচেতন মহল মনে করছেন, শুধু বাল্যবিয়ের সময়ই নয়, বিয়ের পরও যদি বর-কনে পক্ষকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে বাল্যবিয়ে অনেকটাই কমে যাবে। উপজেলার যে সব কাজীরা অর্থের লোভে বাল্যবিয়ে সম্পাদন করে আসছেন তাদেরও সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এ বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সভায় বাল্যবিয়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রশাসন বাল্যবিয়ে রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি, স্কুল শিক্ষক, মৌলভী, রেজিস্টারসহ যে কারো বিরুদ্ধে দু’বছরের মধ্যে বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বোঝায় শিশু বা নাবালক বয়সে ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন অনুযায়ী ছেলেমেয়ে উভয়েরই বা একজনের বয়স ছেলের ক্ষেত্রে ২১ বছর এবং মেয়ের ক্ষেত্রে ১৮ বছর) বয়সের চেয়ে কম হলে তা আইনত বাল্যবিবাহ বলে চিহ্নিত হবে।

বাল্যবিবাহ তিন ধরনের হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কের সঙ্গে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিবাহ এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কের মাতা-পিতা, অভিভাবক কর্তৃক বিবাহ নির্ধারণ অথবা এ রকম বিবাহে সম্মতি দান। যারা এ অপরাধে অপরাধী, তাদের মধ্যে ছেলেমেয়ের অভিভাবক, ছেলেমেয়ে (যদি ২১ বছরের নিচে হয় অথবা মেয়ে যদি ১৮ বছরের নিচে হয়), কাজী যিনি বিবাহ রেজিস্ট্রি করাবেন, মৌলভী যিনি বিবাহ পড়াবেন, তাদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তবে এ আইনে শাস্তির যে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তা বেশ কম।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো ছেলে অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো মেয়ে শিশুর সঙ্গে বিয়ের চুক্তি সম্পাদন করলে এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকারের শাস্তি হতে পারে। যে ব্যক্তি নাবালকের বিয়ে দেবে, তার এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকারের শাস্তি হতে পারে। যেসব অভিভাবক নাবালকের বিয়ে দেবে, তাদের এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকারের সাজা হতে পারে।

বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত নতুন আইন করার প্রাক্কালে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর একটি প্রস্তাব করা হচ্ছিল। এ নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় হয়। তবে সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরই থাকছে। তাই বর্তমান আইনে বিয়ের বয়সের কোনো হেরফের হচ্ছে না। অতএব বাল্যবিয়ে রুখতে আমাদের সকলকে এক সাথে কাজ করতে হবে।

  • 57
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে