রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২০; সময়: ১২:২১ অপরাহ্ণ |
রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দিনটি ছিল বুধবার। আর দশটি সকালের মতোই ছিল সেদিনের সকাল। কিন্তু একটি হত্যাকাণ্ড নজর কেড়ে নিয়েছিল সারাদেশের মানুষের। বরগুনার আলোচিত সেই রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায় হয়েছে বুধবার। এ মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। এ সময় বাকি চার আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে।

বুধবার দুপুরে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন। রায় শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। আর সন্তোষ প্রকাশ করেন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ।

কী ঘটেছিল রিফাত হত্যা মামলার পুরো বিচারিক প্রক্রিয়ায়। কীভাবে শেষ হলো বিচারিক কার্যক্রম। পুরো ঘটনাচক্রটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:

হত্যাকাণ্ড

২০১৯ সালের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে গুরুতর আহত করে। এরপর বীরদর্পে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ছাড়েন তারা।

সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজীসহ তাদের অনুসারীরা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি এ সময় প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন রিফাতকে বাঁচানোর। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে রিফাতকে বরগুনা সদর জেনারেল হাসপাতালে ও পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে ওই দিন বিকেলেই রিফাত মারা যান।

মামলা দায়ের

ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। মামলায় প্রথমে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়। আসামিরা হলেন- সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড, মো. রিফাত ফরাজী, মো. রিশান ফরাজী, চন্দন, মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রায়হান, মো. হাসান, রিফাত, অলি ও টিকটক হৃদয়।

পুলিশি কার্যক্রম

রিফাত শরীফের ওপর হামলার দিন সন্ধ্যায় এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এ ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার শুরু করে পুলিশ। পর্যায়ক্রমে আধুনিক প্রযুক্তি ও বরগুনার এসপির দিক-নির্দেশনায় একে একে সব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ক্রসফায়ার

২০১৯ সালের ২ জুলাই ভোরে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউপির পূর্ব বুড়িরচর গ্রামে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড। এ সময় পুলিশ জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ভোরে নয়ন বন্ডকে গ্রেপ্তারের জন্য বুড়িরচর গ্রামে যায় বরগুনা সদর থানার পুলিশ। ওই গ্রামের খলিল মাস্টারের বাড়ির সামনে গেলে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় নয়ন। হামলায় বরগুনার অ্যাডিশনাল এসপি শাহজাহানসহ পুলিশের চার সদস্য আহত হন। এরমধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।

রিফাতের বাবার সংবাদ সম্মেলন

রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় পুত্রবধূ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি জড়িত উল্লেখ করে তাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এ সময় তিনি মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়ে ১০টি কারণ উল্লেখ করেন। কারণগুলো হলো:

১. নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের ঘটনা সে ও তার পরিবার কৌশলে গোপন করে গেছে।

২. বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় শরিয়া বহির্ভূতভাবে মিন্নি আমার ছেলে রিফাতকে বিয়ে করেছে।

৩. রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও মিন্নি নয়নের বাসায় যাওয়া আসা করে এবং নিয়মিতভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। নয়ন বন্ডের মা একাধিক সংবাদ মাধ্যমকে এ বিষয়সহ আরো অনেক তথ্য দিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

৪. এরই ধারাবাহিকতায় মিন্নি ঘটনার আগের দিন ২৫ জুন সকাল আনুমানিক ৯টায় এবং সন্ধ্যায় নয়নের বাসায় যায় বলে আমি জানতে পেরেছি।

৫. মিন্নি অন্যান্য দিনে রিফাতকে ছাড়া কলেজে গেলেও ঘটনার দিন রিফাতকে কলেজে ডেকে নিয়ে যায়।

৬. রিফাত ঘটনার আগ মুহূর্তে মোটরসাইকেলে কলেজ থেকে মিন্নিকে আনতে যায়। কিন্তু মিন্নি মোটরসাইকেল পর্যন্ত এলেও চক্রান্তকারীদের উপস্থিতি না দেখে কালক্ষেপণের জন্য পুনরায় কলেজের দিকে ফিরে যাচ্ছিল এবং রিফাত মিন্নিকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছিল- যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে আপনারা জেনেছেন।

৭. মিডিয়ায় প্রকাশিত নতুন ভিডিও ফুটেজে দেখলাম প্রথমে যখন আমার প্রিয় ছেলেকে রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও অন্যরা জাপটে ধরে মারধর করতে করতে পূর্ব দিকে নিয়ে যায়, তখন মিন্নি অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে পেছনে পেছনে হাঁটছিল, যা একজন স্ত্রীর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই স্বাভাবিক আচরণ ছিল না।

৮. এছাড়া মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, স্বামীকে কোপানোর সময় মিন্নি আসামিকে জাপটে ধরেছে, কিন্তু আসামি নয়নসহ অন্যন্য আসামিদের কেউই একটি বারের জন্যও মিন্নির ওপর চড়াও হয়নি এবং কোনোভাবেই মিন্নি আক্রান্ত হয়নি।

৯. যখন তার স্বামী রিফাত আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় একা একা রিকশায় হাসপাতালে যাচ্ছিল, তখন মিন্নি তার ব্যাগ ও স্যান্ডেল গোছানোর কাজেই ব্যস্ত ছিল এবং আসামিদের একজন রাস্তা থেকে ব্যাগ তুলে মিন্নির হাতে দিচ্ছিল।

১০. এছাড়া আমার প্রিয় ছেলে রিফাত শরীফকে অ্যাম্বুলেন্সে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় মিন্নি রিফাতের সঙ্গে বরিশাল যায়নি।

মিন্নির সংবাদ সম্মেলন

১৪ জুলাই বরগুনা পৌর শহরের নয়াকাটা মাইঠা এলাকায় নিজ বাসভবনে শ্বশুরের অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। এ সময় তিনি বলেন, ০০৭ গ্রুপ বরগুনায় যারা সৃষ্টি করেছেন তারা খুবই ক্ষমতাবান ও অর্থশালী। তাই তারা বিচারের আওতা থেকে দূরে থাকার জন্য আমার শ্বশুরকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে রিফাত হত্যার বিচারকে অন্যদিকে প্রবাহিত করছে। আমি মনে করি, খুনিদের আড়াল করতেই আমার বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ সময় তিনি তার শ্বশুরের করা সংবাদ সম্মেলনকে ভিত্তিহীন দাবি করেন।

মিন্নি গ্রেপ্তার

২০১৯ সালের ১৬ জুলাই সকাল পৌনে ১০টার দিকে বরগুনার অ্যাডিশনাল এসপির (সদর সার্কেল) নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম মিন্নিকে বরগুনা পৌর শহরের মাইঠা এলাকার তার বাবার বাড়ি থেকে পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে। এ সময় সঙ্গে তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরকেও নিয়ে আসা হয়। তবে বেলা ১১টার পর মিন্নির কাছ থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। রাতে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মিন্নির গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন বরগুনার এসপি মো. মারুফ হোসেন।

মিন্নির জামিন

২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যা মামলায় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির দুই শর্তে জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। শর্ত দুটি হলো- মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না ও তাকে তার বাবার জিম্মায় থাকতে হবে। হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জামিনে থাকা অবস্থায় মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললে তার জামিন বাতিল হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করেন আদালত।

পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল (চার্জশিট)

রিফাত হত্যাকাণ্ডের দুই মাস ছয় দিন পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এরমধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামি এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। একইসঙ্গে রিফাত হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

চার্জ গঠন

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। অন্যদিকে ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বরগুনার শিশু আদালত।

সাক্ষ্যগ্রহণ

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। মামলার প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ, ডাক্তার ও সিআইডি কর্মকর্তাসহ ৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২৫ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে আদালত।

যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও রায়ের তারিখ নির্ধারণ

সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থান করেন। এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক খণ্ডন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। পুনরায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক খণ্ডন করেন ১৬ সেপ্টেম্বর। এ দিনই আদালতের বিচারক রিফাত হত্যা মামলার তারিখ নির্ধারণ করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করে আদালত।

সূত্র : ডেইলি বাংলাদেশ

  • 10
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে