জয়পুরহাটে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়া আসমকে আ.লীগ থেকে বহিস্কার

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০; সময়: ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ |
জয়পুরহাটে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়া আসমকে আ.লীগ থেকে বহিস্কার

এস এম শফিকুল ইসলাম নিজস্ব প্রতিবেদক, জয়পুরহাট : বীরঙ্গনা মুক্তযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়া আসমা বিবিকে জয়পুরহাট সদর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ও দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়েছে।

বয়স, জম্মনিবন্ধন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জেলা- উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন জালিয়াতি করে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করার আবেদন কারায় তাঁর বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। জয়পুরহাট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেবেকা সুলতানা ও সাধারণ সম্পাদ মাহফুজা মন্ডল স্বাক্ষরিত প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

জানতে চাইলে জয়পুরহাট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেবেকা সুলতান বুধবার দুপুরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আসমা বিবির বয়স ছিল আট বছর। তিনি সেই সময় ২২ বছরের যুবতি ছিলেন দেখিয়ে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে দাবি করেছেন। বীরঙ্গনা মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে তাঁর দেওয়া সবকিছুই ভূয়া । কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের নির্দেশে গতকাল মঙ্গলবার আমরা দলীয় পদ ও দল থেকে স্থায়ীভাবে তাঁকে বহিস্কার করেছি।

মোছাঃ আসমা বিবি নিজেকে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করার জন্য গত ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেন। তিনি আবেদনে স্বামীর পরির্বতে বাবা ইসমাইল ফকিরের নাম ব্যবহার করেছেন। তিনি আবেদনপত্রে বীরঙ্গনা হিসেবে থানা কমাণ্ডার প্রত্যায়নপত্র, ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যায়নপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক প্রত্যায়নপত্র, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমণ্ডোরের প্রত্যায়নপত্র সংযুক্তি দিয়েছেন বলে আবেদনপত্রে উল্লেখ করেছেন।

জামুকায় করা আবেদনপত্রে মোছাঃ আসমা বিবি উল্লেখ করেছেন, তিনি একজন প্রকৃত বীরঙ্গনা মহিলা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর কর্তৃক নির্মম শারীরিকভাবে ধর্ষিত হন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজাকারদের তথ্যের মাধ্যমে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁকে ধরে নিয়ে ব্রিজের (সেতু) দক্ষিণ পাশে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের বাংকারের ভেতর রেখে নির্যাতিত ও ধর্ষণ করা হয়। জয়পুরহাটের বাঘা বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা গুলাগুলি করলে ক্যাম্প থেকে পাক বাহিনীরা পালিয়ে গেলে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।

পরে তিনি সহযোগী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি তাঁর বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে গেজেভূক্ত করার আকুল আবেদন জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫৫৩৬৪২১২৯৯ নম্বরে জাতীয় পরিচয়পত্রটি মোছা আসমা বিবির। সেখানে তাঁর জম্ম তারিখ রয়েছে, ২০ ডিসেম্বর ১৯৬২ সাল। সেই হিসেব অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় মোছাঃ আসমা বিবির বয়স ছিল আট বছর তিন মাস ছয় দিন। অথাৎ মোছা আসমা বিবি তখন শিশু ছিলেন। ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবের যৌথ স্বাক্ষরে ইস্যুকৃত জম্ম সনদে মোছাঃ আসমা বিবির জম্ম তারিখ ২০ ডিসেম্বর ১৯৫০ সাল উল্লেখ করা হয়েছে। জম্ম সনদে পিতার নামের পরির্বতে স্বামী আব্দুস সামাদ শেখ রয়েছে। এই জম্ম সনদ অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে সময় মোছাঃ আসমা বিবি বিশ বছরের যুবতী ছিলেন। জম্ম সনদের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা বয়স সংশোধনের জন্য তিনি কমিশনে আবেদন করেছিলেন।

বয়স প্রমাণ হিসেবে তিনি উত্তর জয়পুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৩ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন এমন প্রত্যায়নও জমা দিয়েছিলেন কমিশনে। তথ্য গড়মিল থাকায় কমিশন মোছাঃ আসমা বিবির বয়স সংশোধনের আবেদন বাতিল করেছে। তিনি একাধিক বার চেষ্টা করেও বয়স সংশোধন করতে পারেননি। কমিশন মোছাঃ আসমা বিবির জম্ম তারিখ ১৯৬২ সালের ২০ ডিসেম্বরই বহাল রেখেছে। এরমধ্যে মোছাঃ আসমা বিবি বীরঙ্গনা প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহ করেন।

২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি নিজেকে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক বরাবরে আবেদন। এরই প্রেক্ষিতে জামুকার সহকারী পরিচালক আব্দুল খালেক চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বিশেষ কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে চিঠি ইস্যু করেন। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন চন্দ্র রায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহানাজ সিগমাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। গত ২৪ জুন এই কমিটি মোছাঃ আছমা বেগমকে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করার সুপারিশ করে ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এরপর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি মোছাঃ আসমা বিবির আবেদনটি সুপারিশ করে জেলা কমিটিতে পাঠিয়েছে। এ ঘটনাটি বাহিরে জানাজানি হওয়ার পর জয়পুরহাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম আলী মোছাঃ আসমা বিবির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর সংশ্লিষ্টরা আসমা বিবিকে কোন প্রত্যায়নপত্র দেননি বলে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।

জয়পুরহাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মোছাঃ আসমা বিবি শিশু বয়সের ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছরে এসে তখনকার শিশু মোছাঃ আসমা বিবি বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেছেন। এতে হতবাক ও বিস্মিত হয়েছি। একারণে মোছাঃ আসমা বিবির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। আসমা বিবি জয়পুরহাট সদর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক পদে আছেন। তাঁর এমন কর্মকান্ডে আমাদের দলেরও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। আসমা বিবিসহ এঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।

এ বিষয়ে জয়পুরহাট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মাহফুজা মন্ডল রিনা বলেন, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় প্রতিপন্ন করার তার এমন ঘৃণ্য অপচেষ্টা সংগঠনের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে। তাই আছমা বিবির সদর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ সহ সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে অভিযুক্ত মোছাঃ আসমা বিবি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বিশ বছর ছিল। সেই সময় পাক হানাদারেরা আমাকে নির্যাতন করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান, থানা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আমাকে বীরঙ্গনা হিসেবে প্রত্যায়ন দিয়েছে। আমাকে বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করার জন্য জামুকায় আবেদন করেছি। আমি প্রকৃত পক্ষেই একজন বীরাঙ্গনা। আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই আওয়ামী লীগের কেউ কেউ উঠে পড়ে লেগেছেন।

  • 10
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে