শিবগঞ্জ পৌর নির্বাচনে এবারো নৌকায় উঠতে চান রাজাকার পুত্র

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০; সময়: ৬:০৩ অপরাহ্ণ |
শিবগঞ্জ পৌর নির্বাচনে এবারো নৌকায় উঠতে চান রাজাকার পুত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক : বারবার আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেও আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে শিবগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার ও জামায়াত নেতার পুত্র কারিমুল হক রাজিন নৌকায় উঠতে চান। এজন্য তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের সাথে জোর লবিং চালাচ্ছেন। জামায়াত থেকে আসা এক ঝাঁক ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এলাকায় সৃষ্টি করেছেন আলাদা বলয়। এ নিয়ে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সাথে প্রায়ই সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জানান, রাজিনের বাবা একজন কুখ্যাত রাজাকার ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা লালনের হত্যাকারি। দেশ স্বাধীনের পর তার বাবা মুসলিমলীগ ও জামায়াত ইসলামীর শীর্ষ নেতা ছিলেন। মা এখনো জামাতের রোকন পদে থেকে গোপন সভা করে বেড়ান।

তবে ২০০৮ সাল থেকে রাজিন বরাবরই থাকছেন আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদদের আস্থাভাজন ও অত্যন্ত ঘনিষ্টজন হিসেবে। তাদের বদৌলতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পদ বাগিয়ে নিলেও ওসিকে মারপিট ও দলীয় প্রার্থীর বিরোধীতা করায় দু-দফাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীর বিরোধিতা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জামায়াত-বিএনপি ও স্থানীয় এমপির সমর্থন নিয়ে মেয়রও হন। এবার তিনি চাইছেন আওয়ামী লীগের দলীয় মেয়র প্রার্থী হতে।

শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুল ইসলাম টুটুল খান বলেন, ‘রাজিনের বাবা আজিজুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা লালনকে হত্যা করেছিলেন রাজিনের বাবা। মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতের শিবগঞ্জ উপজেলা আমির ছিলেন তিনি। জামায়াতের দলীয় প্রার্থী হিসেবে শিবগঞ্জ সদর ইউনিয়ন থেকে দুইবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে ভোট করে পরাজিত হন।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে সেখানকার সাবেক সাংসদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিগ্রেডিয়ার এনামুল হকের হাত ধরে উপজেলা ছাত্রলীগের চার নম্বর সহসভাপতি ও পরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন রাজিন। ২০১১ সালে পৌর শিবিরের সভাপতি মান্নানকে ছাড়াতে গিয়ে থানার ভেতরেই ওসিকে চেয়ার দিয়ে মারার অভিযোগে রাজিনকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বহিষ্কার করে। ২০১৩ সালে একইভাবে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মইন খান। রাজিন নৌকার বিরোধিতা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হন। ভোটে জামায়াত-বিএনপির সমর্থন এবং তৎকালীন স্থানীয় এমপি গোলাম রাব্বানীর সমর্থন নিয়ে তিনি ভোটে মেয়র পদে বিজয়ী হন। তবে এবারো আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন।

এরপর ২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে রাজিন নৌকার প্রার্থী সৈয়দ নজরুল ইসলামের বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মহসিন আলীর পক্ষে প্রকোশ্যে কাজ করেন। ওই নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহবায়কও ছিলেন।’

আতিকুল ইসলাম টুটুল খান বলেন, ‘রাজিন বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের আদর্শ বিশ্বাস করেন না। আওয়ামী লীগে ঢুকে জামায়াত বিএনপির আদর্শ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। সে কখনোই আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট করেনি। এবার নৌকার প্রার্থী হতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তবে উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সবাই তাকে বয়কট করছে।’

শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু আহমেদ নাজমুল করিম মুক্তা বলেন, ‘বারবার আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে আসলেও স্থানীয় এমপিরা বরাবরই রাজিনকে ঘরে তুলে নিয়েছেন। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনজন এমপি হয়েছেন, চাটুকারিতার কারণে সবাই রাজিনকে আপন করে নিয়েছেন। সাংসদ বিগ্রেডিয়ার এনামুল তাকে ছাত্রলীগের পদ দেন, পরের সাংসদ গোলাম রাব্বানী তাকে মেয়র বানান, বর্তমানে সাংসদ ডা. সামিল উদ্দীন আহমেদ শিমুলের সমর্থন নিয়ে আবারো নৌকায় উঠতে চাচ্ছেন। কিন্তু রাজিন কখনোই আওয়ামী লীগকে আপন করেননি। তিনি রাজাকার এবং জামায়াত নেতার পুত্র। সে আদর্শই তার মনে। বারবারই তিনি নৌকার বিরোধিতা করে তার প্রমাণ দিয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘২০১৩-২০১৪ সালে জামায়াতের নাশকতার সময় অনেক জামায়াত-শিবির নেতাকে মামলা থেকে বাঁচানো এবং চাকরি দেয়ার কথা বলে টাকা নেয়। একারণে অনেকের বিরাগভাজন হন। টাকা দেয়ার পরও নাশকতার মামলার আসামী এবং চাকরি না হওয়ায় ওই সময় তার পা কেটে নেয়। এঘটনাকে পুঁজি করে নিজেকে রানাপ্লাজা ধ্বসে আহত দেখিয়ে ৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়েছিলো। বরাবরই সে ধূর্ত প্রকৃতির একজন মানুষ।’

শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শিবগঞ্জ উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের একটি অংশের সাথে আতাঁত করেই রাজিন নৌকা পেতে এবার মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

শিবগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি হিমেল জানান, রাজিন তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলাকে নেশার স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। তার অনুসারীদের অধিকাংশই নেশাগ্রস্ত।

এবিষয়ে শিবগঞ্জ আসনের সাংসদ ডা. সামিল উদ্দীন আহমেদ শিমুল বলেন, ‘তার বাবা মুসলিম লীগ করতো। ৮৬ সালে আমার বাবা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী দলীয় প্রার্থী হলে রাজিনের বাবা ছিলেন মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন। এরপর জামায়াত করতেন। তার মা কি করেন, তা জানি না।

কুখ্যাত রাজাকার ও জামায়াত পরিবারের সন্তানকে দলে রাখার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আগে পিছে সবাই হাইব্রিড, আমি কোথায় যাবো? এমপি ভোটে রাজিন আমাকে সহযোগিতা করেছে। তবে উপজেলা নির্বাচনে রাজিন বিদ্রোহী প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলো বলে শুনেছি।’

রানাপ্লাজার শ্রমিক না হয়েও পরিচয় দিয়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে সাংসদ শিমুল বলেন, ‘ওই ঘটনায় বিদেশ থেকে একটা চিকিৎসক টিম এসেছিলো। ওই সময় রাজিন সেখানে নিজেকে রানাপ্লাজার শ্রমিক পরিচয়ে কৃত্রিম পা লাগিয়ে নেন। তবে ৮ লাখ টাকা নিয়েছিলো কি না তা জানা নেই।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র কারিমুল হক রাজিন সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বাবা রাজাকার বা জামাত নেতা ছিলেন না। তবে তিনি মুসলিম লীগ করতেন। ওই সময় দলীয় প্রার্থী হবার বিষয়টিও ছিলো না। এলাকাভিক্তিক সমর্থন হয়তো করেছে সবাই। আমার মা জিন্নাত আরা কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত নন।

তিনি বলেন, আমি জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ হতে পারিনি, তবে জ্ঞান হবার পর থেকেই আওয়ামী লীগ করি। রানাপ্লাজার শ্রমিক পরিচয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ওই সময় রানা প্লাজার আহতদের জন্য ১০০টি এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য ৩০টি পা আনা হয়েছিলো। সেখান থেকে আমাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিল্লার রহমান একটি পা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে গতবার ভোট না করলে এখানে জামাত-বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হতো। পরিস্থিতির কারণেই গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতা করে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট করেছি।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে