নিয়ামতপুরে জীবন সংগ্রামে সফল দুই নারী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০; সময়: ১২:০৫ অপরাহ্ণ |
নিয়ামতপুরে জীবন সংগ্রামে সফল দুই নারী

নিজস্ব প্রতিবেদক, নিয়ামতপুর : সীমাযারা নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের খড়িবাড়ী ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের এক অসহায় দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। তার জন্ম ১৯৮৫ সালের ১০ মে। বাবা মৃত- আকিমুদ্দিন, মা মৃত- সওদা বিবি খুব কষ্ট করেই তাঁকে বড় করে তুলেছিলেন। এরই মাঝে সীমায়ারার জীবনে নেমে আসে এক ভয়াল অন্ধকার। কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশের গ্রাম শ্যামপুরের জাহাঙ্গীর আলমের সাথে তা বিয়ে হয়। বিয়ের মাত্র ১৮ মাসের মাথায় তিন মাসের এক পুত্র সন্তান নিয়ে হন স্বামী সংসার ছাড়া। নেশাগ্রস্ত স্বামী জাহাঙ্গীর আলম তাকে তালাক দেন। সীমারায়া ফিরে আসেন বাবার বাড়ীতে। কিন্তু অসহায় দরিদ্র বাবা তাকে ও তার সন্তানকে ভরণ পোষন দিতে পারছিলেন না ঠিকমত। নিরুপায় হয়ে সীমাযারা চলে যান রাজশাহীর হেতেমখাঁ এলাকায়। সেখানে তিনি বাড়ী বাড়ী ঝিয়ের কাজ করে কোন রকমে নিজের ও সন্তানের জীবিকা নির্বাহ করতেন। সন্তানও বাক প্রতিবন্ধি। ঠিকমত কোন কিছু বলতে বা করতে পারে না।

কথা হয় সীমায়ারা সাথে। সে এ প্রতিবেদককে বলেন রাজশাহীতে ঝিয়ের কাজ করে কোন রকমে চলে যাচ্ছিল আমার জীবন। এর মধ্যে আমি জানতে পারে খড়িবাড়ী বাজারে সরকারীভাবে দোকানঘর নির্মান করে অসহায় দরিদ্র নারীদের প্রদান করা হবে। আমি আমার মামাতো ভাই বাদলের মাধ্যমে দোকান ঘর পাবার জন্য আবেদন করি। দোকান ঘর পাবার পর শুরু হয় আমার সংগ্রামী জীবন। ঘর পাবার পরেও দোকান করার মত কোন পুজি ছিল না। অবশেষে সাদাপুর গ্রামের সিদ্দিক হোসেন চৌধুরী নিজে আমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। আমি তার ঋন কোনদিনও শোধ করতে পারবো না। চায়র স্টল করে আমি আমার সন্তানকে নিয়ে এখন খুব ভাল আছি। পরের বাড়ীতে আর ঝিয়ের কাজ করতে হয় না। শুধু আফসোস সন্তান প্রতিবন্ধি হওয়ায় তাকে লিখাপড়া করাতে পারি নাই। প্রথমে ভাড়া বাড়ীতে থাকলেও বর্তমানে সে নিজের বাড়ীতে থাকেন। তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন যদি কখনও সুযোগ হয় তাহলে এই খড়িবাড়ী বাজারেই একটি সুন্দর কসমেটিকস এর দোকান করবো।

সীমায়ারা এমনই এক আত্মপ্রত্যয়ী ও দেশপ্রেমিক নারীর নাম যিনি জীবনের সমস্ত বিভীষিকাময় অধ্যায় মুছে ফেলে আজও জীবন সংগ্রমে লড়ে যাচ্ছেন দৃঢ় মনোবল নিয়ে। অনুকরনীয় অনুসরনিয় সীমায়ারার কাছ থেকে আমাদের নারী সমাজের শিখবার রয়েছে অনেক কিছু। ৩৫ বছর বয়সী এই নারী আজও সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে নিজের জীবনের কালো অধ্যায়কে পাথর চাপা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার আরেক সংগ্রামী নারী জোসনায়ারা। স্বামী মৃত ইয়াসিন। সে নিয়ামতপুর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মহিশো গ্রামের বাসিন্দা। বাবার বাড়ী একই ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে। বাবার নাম আব্দুর জব্বার। তার পিতা একজন দরিদ্র কৃষক। কথা হয় জোসনারার সাথে। সে এ প্রতিবেদককে বলেনন, আমার জন্ম ১০ মে ১৯৭৮ সালে। আমি জন্ম গ্রহন করার পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। এক বছর পরেই আমার কোল জুড়ে আসে একটি কন্যা সন্তান, তার পরের বছরেই আসে একটি ছেলে আরো এক বছর পরেই আসে আরেকটি কন্যা সন্তান। প্রথম সন্তান মেয়ে আইরিন, ডিগ্রী পাশ করে তাকে বিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় সন্তান ছেলে নাম শাহরিয়ার হোসেন বর্তমানে কারিগরি শাখায় এইচএসসিতে অধ্যায়নরত। করোনা মহামারীর কারণে পরীক্ষা দিতে পারে নাই। তৃতীয় সন্তান মেয়ে নাম ইভা খাতুন। সেও এইচএসসিতে অধ্যায়নরত। সেও করোনার কারণে পরীক্ষাতে বসে পারে নাই। ১৯৯৪ সালে বিয়ের হবার পর থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমাকে জীবন নির্বাহ করতে হয়। এর মধ্যে ২০০৫ সালে আমার স্বামী মারা যায়। দারিদ্রের কারণে তিন সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ীতে অবস্থান করছিলাম। হাজার কষ্ট হলেও সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ করি নাই। তিন সন্তানকেই লেখাপড়া করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আর এ সবের পিছনে সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার দরিদ্র বাবা।

স্বামী মারা যাওয়ার পর দারিদ্র এবং হতাশার অন্ধকার থেকে বের হয়ে বিবিন্ন বেসরকারী সংস্থা সহযোগিতায় সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছিলেন জোসনায়ারা। একপর্যায়ে সমাজের নানাবিধ কুসংস্কার ও বাধা বিপত্তি দুর করতে জন্য এলাকার সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণে ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ৪,৫,৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার অসহায় নারীদের সচেতন করার জন্য সমাজে উন্নয়ন করার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পদিকাও নির্বাচিত হন। বাবার বাড়ীতে ১২ বছর অবস্থান করার পর বর্তমানে তিনি স্বামীর বাড়ীতে অবস্থান করছেন। তিনি বাল্যবিবাহ, মাদক, ইভটিজিং বিষয়ে এলাকার মানুষকে সচেতন করছেন। তিনি আবারও আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে এলাকার মানুষের সমর্থন পেলে বাল্য বিবাহ, ইভটিজিং, মাদক বন্ধের জন্য আরো জোরালোভাবে কাজ করে যাবেন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে