মান্দায় পরিত্যাক্ত মাথার চুল প্রক্রিয়াজাত করে ভাগ্য বদল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২০; সময়: ৭:৫৫ অপরাহ্ণ |
মান্দায় পরিত্যাক্ত মাথার চুল প্রক্রিয়াজাত করে ভাগ্য বদল

নিজস্ব প্রতিবেদক, নওগাঁ : নারীরা মাথা আঁচড়ানোর পরই উঠে আসা চুল ফেলে দেন। আবার অনেকে জমান। আর সেই জমানো চুল কেনেন ফেরিওয়ালারা। আবার অনেকে বিউটি পার্লারে গিয়েও চুল কাটান। এই সব চুলও কিনে নেন ফেরিওয়ালারা। পরিত্যক্ত এসব চুলকে জীবীকার উৎস বানিয়েছে হাজারো গ্রামীণ নারী-পুরুষের।

পরিত্যক্ত চুলকে ঘিরে নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভারশোঁ ইউনিয়নের মশিদপুর, হোসেনপুুর ও কবুলপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক চুল প্রক্রিয়াজা কেন্দ্র। এসব কারখানাকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো নারী-পুরুষের। বেঁচে থাকার অবলম্বন পেয়েছেন বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী। পাল্টে গেছে এলাকার অনেক তরুণের ভাগ্য।

চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ এসব কেন্দ্রকে ঘিরে আরেক শ্রেণির মানুষের জীবীকার উৎস গড়ে উঠেছে। এরা গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা, বাদাম, প্রসাধনসামগ্রী ও বেলুনের বিনিময়ে নারীদের মাথার পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করে এসব কেন্দ্রে বিক্রি করে। ক্রয় করা এসব চুল বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করা হয় বিদেশী ক্রেতাদের কাছে।

চুল প্রক্রিজাতকরণ কাজের সঙ্গে জড়িত উদ্যেক্তা ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মান্দার ভারশোঁ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে অর্ধশতাধিক চুল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র বা কারখানা গড়ে উঠায় ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র চৌবাড়িয়া বাজারে পরিত্যক্ত চুল কেনা-বেচা হয়ে থাকে। ফেরিওয়ালারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে ফেরি করে কিনে আনা পরিত্যক্ত চুল বিক্রির জন্য এই বাজারে নিয়ে আসেন।

এছাড়া শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে চুল বিক্রি করতে আসেন। ফেরিওয়ালা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কারখানা মালিকেরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা কেজি দরে এসব চুল কিনে নেন। এরপর গুটি চুলগুলো কারখানার নারী কর্মীরা প্রথমে বাছাই করেন। এরপর বাছাই করা এসব তেল ও শ্যাম্বু দিয়ে ওয়াশ করে নেওয়া হয়।

সবশেষে কারখানার প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র দিয়ে আকারভেদে (দৈর্ঘ্য অনুযায়ী) চুলগুলোকে পৃথক করে নেওয়া হয়। বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে এসব চুল রাবার ও সুতা দিয়ে বাঁধেন কর্মীরা। এভাবেই চুল প্রক্রিয়াজাত শেষে চুলগুলো কার্টুন করা হয়। ইঞ্চিভেদে প্রক্রিয়াজাত করা এসব চুল ১০ থেকে ২০ হাজার কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রক্রিয়াজাত করা এ চুল ঢাকাতে চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন দেশীয় এসব উদ্যোক্তা।

গত মঙ্গলবার উপজেলার মশিদপুর ও হোসেনপুর গ্রামের দুটি চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, কেন্দ্রগুলোতে ২০-২৫ জন নারী কর্মীরা মেঝেতে বসে চুলের জটা বা গুটি থেকে সুঁচ বা কাটা দিয়ে জট ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। আবার কেউ জট ছাড়িয়ে নেওয়া এসব চুল হুইল পাউডার ও পরে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। সবশেষে কাঁটা মেশিন হিসেবে পরিচিত একধরণের প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রে দিয়ে জট ছাড়ানো এসব চুল আকারভেদে পৃথক করার কাজ করেন ছয়-সাতজন পুরুষ কর্মী। এরা কারিগর হিসেবে পরিচিত।

এসব কারখানায় গুটি কিংবা জটা থেকে চুল ছাড়ানোর কাজ করেন গ্রামের দরিদ্র নারীরা। বিনিময়ে মাসে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন তাঁরা। অন্যদিকে কারখানায় কর্মরত কারিগরেরা দক্ষতা অনুযায়ী ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন।

১৫ বছর আগে ঢাকার বাসিন্দা চাঁন মিয়া নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে এ এলাকায় শুরু হয় পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসার। শুরুটা একজনের মাধ্যমে হলেও বর্তমানে এখন এ ব্যবসার সঙ্গে অর্ধশতাধিক উদ্যোক্তা জড়িয়ে পড়েছেন। এলাকার অনেক বেকার তরুণ ও যুবক ঝুঁকছেন এ ব্যবসায়।

মেহেরপুর জেলা থেকে এসে তিন বছর ধরে উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা যৌথভাবে গড়ে তুলেছেন মিলন হোসেন ও জুয়েল রানা নামে দুই যুবক।

মিলন হোসেন বলেন, দুটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে তিনি ও জুয়েল রানা নামে আরেক যুবক সেখানে চুল প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা গড়ে তোলেন তিন বছর আগে। তাঁদের কারখানা থেকে প্রতি মাসে ২০০ থেকে ২৫০ কেজি প্রক্রিয়াজাত করা চুল বিক্রি হয়। প্রতি মাসে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বিক্রি হয়ে থাকে। কর্মীদের বেতন, বাড়ি ভাড়া ও আনুষাঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মাসে তাঁদের ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকে।

চুল ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, এ ব্যবসা বৈধ হওয়া সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পরিত্যক্ত এ চুল কিনে আনতে পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নানাভাবে হয়রানি করে এবং তাঁদের কাছ চাঁদা আদায় করে থাকেন।

চুল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে কাজ করে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন মশিদপুর গ্রামের বাসিন্দা মতিজান বেওয়া। তিনি বলেন, চার বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েরা ঠিকমতো তাঁর দেখাশোনা করতেন না। খেয়ে-না খেয়ে তাঁর দিন কাটতো। প্রতিবেশিদের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে তিন বছর আগে হোসেনপুর গ্রামের একটি চুল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে গুটি থেকে চুল ছাড়ানোর কাজ শুরু করেন তিনি। এ কাজ করে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা আয় করে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

ভারশোঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরিত্যক্ত চুল প্রক্রিয়াজাত করার ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না, অন্যদিকে আর্থিক লাভবান হচ্ছেন এলাকার বেকার তরুণ-যুবক উদ্যোক্তারা। এসব চুল ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য তাঁদের সবাইকে ট্রেড লাইসেন্স করে দেওয়া হয়েছে। তবে স্বল্প সুদে কিংবা সুদমুক্ত শর্তে ঋণ পেলে ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করার সুযোগ পেতেন এসব ব্যবসায়ী।

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, চুলের মতো পরিত্যক্ত জিনিসকে নিয়ে কিছু মানুষ অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হওয়ার যে পথ বেঁচে নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমাদের কাছে আসলে এসব উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে এবং তাঁদের ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করতে এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে।

  • 36
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে