ফুলচাষে আলো দেখাচ্ছে ‘ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি’

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২১; সময়: ১২:৫১ অপরাহ্ণ |
ফুলচাষে আলো দেখাচ্ছে ‘ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি’

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ফুলচাষে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে ‘ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি’। স্বল্প খরচে মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে যশোরের ঝিকরগাছায় কৃষকের আস্থা অর্জন করছে এ পদ্ধতি। এ পদ্ধতির ‘ডাগওয়েল (পাতকুয়া) ও পলিহাউজ’ নির্মাণে সহযোগিতা পেলে অধিকাংশ কৃষকই প্রবেশ করবেন ‘চাষের নতুন দুনিয়ায়’।

কৃষকরা জানান, সৌরচালিত পাম্পের সাহায্যে ডাগওয়েল (পাতকুয়া) থেকে পানি তোলা হয়। প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে সেই পানি নেয়া হয় ট্যাঙ্কে। সেখান থেকে সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে পানি চলে যায় ফুলখেতে। পলি হাউজে (বিশেষভাবে নির্মিত শেড) নিয়ন্ত্রিত পানি সরবরাহের কারণে অপচয়ও হয় না। পাইপে পানির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয় পরিমাণ মতো রাসায়নিক সার। ফুল গাছের গোড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে সেই সারমিশ্রিত পানি। পলি হাউজে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ না থাকায় কীটনাশকের ব্যবহারও তেমন লাগে না। ‘ড্রিপ ইরিগেশন’ নামের এ পদ্ধতি ঝিকরগাছার গদখালী এলাকায় বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) যশোরের সেচ বিভাগ। সুবিধা বিবেচনায় দিন দিন তা জনপ্রিয় হচ্ছে কৃষকদের মাঝে।

বিএডিসি যশোর অফিস সূত্র জানায়, তিন বছর মেয়াদি ‘যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় ফুল ও সবজি উৎপাদন সম্প্রসারণে ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতি’ প্রকল্প শুরু হয় ২০১৭ সালের জুনে। বিএডিসি যশোরের সেচ বিভাগের বাস্তবায়নে খনন করা হয় সৌরচালিত ডাগওয়েল (পাতকুয়া), নির্মাণ করা হয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার ও পলিহাউজ। ১৪০ ফুট গভীর এ ডাগওয়েল (পাতকুয়া) নির্মাণ করা হয় ১৫টি। ১০১০ বর্গমিটার দৈর্ঘে্যর লোহার কাঠামোর ওপর সাদা পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয় পলি হাউজ। পলি হাউজ নির্মিত হয়েছে সাতটি।

সরেজমিনে ঝিকরগাছার গদখালী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক বিঘা জমির ওপর লোহার কাঠামোয় সাদা পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পলি হাউজ। পাশেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সংরক্ষণাগার। একটু দূরে পাতকুয়া। পাতকুয়ায় রয়েছে পাম্প, উপরে সোলার প্যানেল। ১০ মিনিট পাম্প চালালে ট্যাঙ্কটি পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সেখান থেকে সরবরাহ পাইপলাইনে পানি যাচ্ছে পলি হাউজ এবং আশপাশের সবজি ও ফুলখেতে। পলি হাউজের পাইপলাইনে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে রাসায়নিক সার।

সার মিশ্রিত পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে গাছের গোড়ায়। পলি হাউজের উপরে পলিথিন উঠানো নামানো করে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাপমাত্রা। গ্রীষ্মে উপরে পানির স্প্রে করেও তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী গ্রামের কৃষক মঞ্জুর আলম বিএডিসির ডাগওয়েল ও শেড (পলি হাউজ) দুটোই গ্রহণ করেন। তিনি জানান, এ শেডে ফুল ও সবজি দুটোই চাষ হচ্ছে। এখন চাষ করছেন ক্যাপসিকাম। পলি হাউজের চাষে বহুবিধ সুবিধা। একেবারে গাছের গোড়ায় সারমিশ্রিত পানি সরবরাহ করায় পানি ও সারের অপচয় একদমই হয় না। খরচ বেচে যায়। আগাছাও তেমন জন্মায় না।

ফলে বাড়তি শ্রমিকেরও প্রয়োজন হয় না। শেডের মধ্যে পোকামাকড় প্রবেশের সুযোগ না থাকায় কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয় না। ফলে সাশ্রয়ী উৎপাদন ব্যয়ে মানসম্মত বিষমুক্ত সবজি ও ফুল উৎপাদন সম্ভব হয়। তিনি আরও জানান, এ সেচের আওতায় (ডাগওয়েল ও পলি হাউজ) আসতে তাদের ১২ হাজার টাকা জামানত দিতে হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে এগুলো নির্মাণ করতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা প্রয়োজন। কোনো কৃষকের পক্ষে এ ব্যয় অসম্ভব। এজন্য সরকারের সহযোগিতা চান তিনি। পাশাপাশি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় বিএডিসিকে ধন্যবাদ জানান।

একই এলাকার কৃষক ইসরাফিল হোসেন জানান, ডাগওয়েল বা পাতকুয়া থেকে সৌরচালিত পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হয়। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি উপরে থাকা চোঙার মাধ্যমে কুয়ায় নেমে আসে। সেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি যায় সোজা শেডের ফুল ও সবজি গাছের গোড়ায়। আশপাশের কৃষকরাও তাদের খেতে এ সেচ সুবিধা গ্রহণ করছেন। পানি সেচ দিতে বিদ্যুৎ বা ডিজেলের প্রয়োজন হয় না।

পানিসারা গ্রামের কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘পলি হাউজের উপরের দিকে রয়েছে ফগার মেশিন। সেখান থেকে কুয়াশার মতো করে পানি বের হয়। পলি হাউজের পলিথিন ওঠানামা করিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে এখানে অনায়াসেই গ্রীষ্মকালে শীতকালীন সবজি-ফুল চাষাবাদ করছেন। দিন দিন আবহাওয়া-তাপমাত্রা যেভাবে বিরূপ আচরণ করছে, তাতে ভবিষ্যতে এ শেড ছাড়া মানসম্মত চাষাবাদ দুরূহ হয়ে পড়বে।

তিনি উল্লেখ করেন, ব্যক্তি পর্যায়ে ডাগওয়েল বা পলি হাউজ নির্মাণ করা কঠিন। এ জন্য কৃষকদের প্রণোদনা বা নামমাত্র সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। সেটি সম্ভব হলে এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকই এটি গ্রহণ করে উন্নতমানের চাষাবাদে যুক্ত হবেন।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, ঢালাও সেচে পানির অনেক অপচয় হয়। এ পদ্ধতিতে সার-পানির পরিমিত ব্যবহার করা যায়। তাপমাত্রা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হওয়ায় ফুল ও সবজি চাষে খরচ ও ঝুঁকিও অনেক কমে যায়। ফলে কৃষকের মাঝে এটি সাড়া ফেলেছে। অন্যান্য কৃষকরা আগ্রহী হলেও পলি হাউজ, পাতকুয়া নির্মাণ ব্যয় নিয়ে তারা চিন্তিত। এজন্য সরকারি প্রণোদনা বা সহযোগিতা প্রয়োজন। সেটি হলে গোটা অঞ্চলই ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতিতে চলে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), যশোরের সেচ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহাবুব আলম জানান, তিন বছরের এ কর্মসূচিতে সাতটি পলি হাউজ ও ১৫টি সোলার ডাগওয়েল নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দুই শতাধিক কৃষক সুফল পাচ্ছেন। এখানে ব্যবহার হচ্ছে সৌরশক্তি। পলি হাউজে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও পানি সরবরাহের কারণে অপচয়ও হয় না। বরং ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পানি সাশ্রয় হয়। পোকামাকড়ের আক্রমণ না থাকায় কীটনাশকের ব্যবহারও তেমন লাগে না। সবমিলে এখানে ফুল-সবজি উৎপাদন খরচ কম এবং ফলন অনেক বেশি হয়।

  • 5
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে