রাজশাহীতে বছরে ৭৯ কোটি টাকার হলুদের ব্যবসা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২০; সময়: ১:৪৩ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে বছরে ৭৯ কোটি টাকার হলুদের ব্যবসা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীতে বছরে ৭৯ কোটি টাকা টাকার মশলাজাতীয় শস্য হলুদের ব্যবসা হয়। হলুদ চাষের সাথে জড়িত আছে রাজশাহীর ১৫ থেকে ১৬ হাজার কৃষক। রাজশাহীর হলুদ ঢাকাসহ সারাদেশে যায়।তবে ভারত থেকে হলুদ আমদানি করা হয় লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষকরা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রাজশাহীতে সব উপজেলায় হলুদ চাষ হলেও জেলার মধ্যে পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হলুদ চাষ হয়।গতবছর রাজশাহী জেলায় এক হাজার ৮৩৯ হেক্টর জমিতে হলুদের চাষাবাদ হয়েছিলো। সেখান থেকে শুকনা হলুদ পাওয়া গেছে ৬ হাজার ৫৫১ মেট্রিক টন।এবছর দুই হাজার ৩৪ মেট্রিক টন জমিতে হলুদের চাষ হয়েছে।আর দুই মাস পর কৃষকরা হলুদ তুলতে পারবেন।

গত ১০ বছরের চাষাবাদের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ হাজার মেট্রিক টন শুকনা হলুদ উৎপাদন হয়েছে রাজশাহীতে। প্রতিকেজি শুকনা হলুদের দাম গড়ে ১২০ টাকা ধরা হলে এক মেট্রিক টন হলুদের দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেহিসেবে ৬ হাজার ৫৫১ মেট্রিক টন হলুদের দাম দাঁড়ায় ৭৮ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে বাজারে শুকনা হলুদ ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়।

বাঘার আড়ানী বাজারের মোল্লা ট্রেডার্সের একটি কারখানায় শুকনা হলুদের পরিচর্যা
ও বাছাই করছেন শ্রমিকরা।

কৃষকরা জানান, হলুদের বীজ জমিতে বপনের পর পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে হলুদ পরিপক্ক হতে। তখন বিঘাপ্রতি কাঁচা হলুদ হয় ৭০ থেকে ৮০ মণ। এরপর সেই কাঁচা হলুদ গরম পানিতে সেদ্ধ করে জমিতে শুকাতে হয়। ২০ থেকে ২৫ দিন শুকানোর পর শুকনো হলুদ পাওয়া যায়। যা বিক্রি করা হয়। শুকনা হলুদ কেজিপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০টাকা কেজি দরে বিক্রি হলে কাঁচা হলুদ বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। চার থেকে পাঁচ মণ কাঁচা হলুদ শুকানোর পর এক মণ শুকনা হলুদ পাওয়া যায়।

কৃষকরা জানান, আগে মাঠভর্তি হলুদ চাষ করতেন কৃষকরা। তখন উৎপাদনও ভালো হতো, দামও বেশি পাওয়া যেত। তবে এখন বেশিরভাগ চাষীরা হলুদ চাষ করেন আম বাগানে সাথী ফসল হিসেবে।আম বাগানে চাষ করায় হলুদের উৎপাদনও কমে গেছে।আগে যেখানে বিঘাপ্রতি ১০০ মণ পর্যন্ত কাঁচা হলুদ পাওয়া যেত এখন সেখানে ৭০ থেকে ৮০ মণ হলুদ পাওয়া যায়। বেশিরভাগ কৃষকরা সাথী ফসল হিসেবে উঁচু ভিটা জমি ও পতিত জমিতে এবং বাড়ির আঙিনায়ও হলুদ চাষ করে থাকেন।

চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক শাহাবুল হক জাহাঙ্গীর জানান, ১০ বছর আগে পাঁচ বিঘা জমিতে হলুদ চাষ করতাম। এখন সেখানে দুই বিঘা জমিতে হলুদ চাষ করছি।তা-ও আম বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করছি।বেশিরভাগ কৃষকরা এখনই সাথী ফসল হিসেবে হলুদ চাষ করেন। কেউ ১০ কাঠা জমিতে, কেউ ১৫ কাঠা জমিতে-এভাবে খন্ড খন্ড জমিতে হলুদ চাষ করেন।সাথী ফসল হিসেবে চাষাবাদ করায় হলুদের উৎপাদনও কমে গেছে।

একই গ্রামের কৃষক মিল্টন মন্ডল জানান, এবছর হলুদে বেশি পচা রোগ দেখা দিয়েছে।গাছের পাতা মরে যাচ্ছে। গাছের পাতা মরে গেলে হলুদের উৎপাদন কমে যায়।কীটনাশক ওষুধ দিয়ে পচা মরা রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। এক বিঘা জমিতে হলুদ চাষ করতে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। প্রথম কয়েকদফা জমি চাষাবাদ করে সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করার পর বীজ বপন করতে হয়। হলুদ গাছ বড় হয়ে গেলে তখন শুধু কীটনাশক দিলেই চলে।

বাঘার আড়ানী এলাকার কৃষক মোখলেসুর রহমান জানান, আগে আড়ানী এলাকার কৃষকরা হলুদ বেচাবিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমন কোনো পরিবার নেই যারা হলুদ চাষ করতেন না। এখন বেশিরভাগ কৃষকই হলুদের চাষ কমিয়ে দিয়েছেন।সেখানে এখন আম বাগান করেছেন। মাঠ ভর্তি সবজি চাষাবাদ করছেন।কারণ সেসব বিক্রি করে তাৎক্ষণিকভাবে বেশি লাভ হওয়া যাচ্ছে। এবছর আমি ৪ কাঠা জমিতে বেগুন বিক্রি করেছি ৬১ হাজার টাকার।যা হলুদ চাষের চেয়ে লাভজনক। তারপরও আমার ১৫ কাঠা জমিতে হলুদ রয়েছে।

রাজশাহীর মধ্যে আড়ানী বাজারে সপ্তাহে দুইদিন হলুদের হাট বসে। সেখানে প্রতি হাটে ৫০০ থেকে এক হাজার মণ হলুদ বেচাকেনা হয়।১০ থেকে ১৫ জন আড়তদার রয়েছে সেখানে।

রাজশাহীর চারঘাটে কালিহাটী গ্রামের এক জমিতে হলুদের পরিচর্যা করছেন এক কৃষক।

মোল্লা ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক নূর মোহাম্মদ মোল্লা জানান, তারা প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ হাজার মণ শুকনা হলুদ বিভিন্ন কৃষকদের কাছ থেকে কিনেন। তারপর সেই হলুদ তাদের কারখানাতে বাছাই করেন।বাছাইয়ের জন্য ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক প্রতিদিন তাদের কারখানায় কাজ করেন। বাছাই শেষে আকৃতিভেদে প্যাকেটজাত করে তারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। আবার সরাসরি হলুদের গুঁড়া তৈরির কোম্পানির কাছেও তারা তাদের হলুদ বিক্রি করেন।

৪৫ বছর ধরে হলুদের ব্যবসার সাথে জড়িত আড়ানী বাজারের একরামুল হক সনৎ। তিনি বলেন, ভারত ও বার্মা থেকে হলুদ আমদানীর কারণে আমাদের দেশের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মার খাচ্ছেন। সরকার প্রায় ৬০ ভাগ হলুদ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করছে।ফলে কৃষক নিজেদের হলুদ উৎপাদন করে তাদের উৎপাদন খরচ তুলতে পারছে না। অথচ অন্য দেশের তুলনায় আমাদের হলুদের কোয়ালিট খুবই ভালো। আগের মতো হলুদ ব্যবসা আর লাভজনক না। বহুবছর ধরে হলুদের ব্যবসা করায় আর এই পেশার মায়া ছাড়তে পারিনি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামসুল হক জানান, আগের চেয়ে আবাদের পরিমাণ কমলেও হেক্টর প্রতি হলুদের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষকরাও হলুদ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।আগে যেখানে কৃষকরা হলুদ লাগিয়ে ফেলে রাখতেন, এখন সেখানে সার, সেচ ও কীটনাশক দেওয়ায় হলুদের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। এছাড়া হাইব্রিড, বারি ও উফসী জাতের কিছু হলুদের উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আমরাও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে হলুদ চাষে কৃষকদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, স্থানীয় জাত বাদ দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ উদ্ভাবিত বেশি ফলনের হলুদ যাতে চাষীরা চাষাবাদ করেন সেই বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

  • 90
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে