কোভিড-১৯ ছাপিয়ে ভাগ্য ফিরোনোর প্রচেষ্টায় ফুলচাষি জাফর

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২০; সময়: ৫:১১ অপরাহ্ণ |
খবর > কৃষি
কোভিড-১৯ ছাপিয়ে ভাগ্য ফিরোনোর প্রচেষ্টায় ফুলচাষি জাফর

নিজস্ব প্রতিবেদক : লকডাউনে স্থবির হয়ে পড়েছিল ফুল ব্যবসা। সেই সঙ্গে রোজগার বন্ধ হয়েছে বিপুলসংখ্যক ফুল চাষি ও ব্যসায়ীদের। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল তাদের জীবনযাত্রা। তবে লকডাউন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে চাষিদের ভাগ্য। কিন্তু বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে চাহিদার অর্ধেকও হয় না ফুল চাষ। বিশেষ করে রাজশাহীর জন্য একটি লাভজনক খাত হতে পারে ফুল চাষ।

করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে এবারের পহেলা বৈশাখসহ কোন ধরণের উৎসবে কোনো ফুল কেনা-বেচা হয়নি। যে কারণে দিশেহারা দেশের সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদনকারী যশোরসহ রাজশাহী এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা। পর পর কয়েকটি ফুল বিক্রির মৌসুমে ফুল বিক্রি করতে পারেননি তারা। ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ ও পহেলা বৈশাখে বিপুলপরিমাণ ফুল বেচাকেনা হয়। তবে করোনার কারণে বন্ধ সব অনুষ্ঠান আয়োজন। ছিল না কোনো বেচাকেনা। সে কারণে ক্ষেতের ফুল ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছে। অনেকে ফুল কাটলেও বিক্রি করতে না পেরে গরু-ছাগলে খেয়েছে। যে কারণে কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়েছে সারা দেশের মত রাজশাহীর ফুলচাষিদের। তবে ফুলচাষিদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকারি অনুদান সহায়তা পাবার কথা থাকলেও রাজশাহীর কেহই অনুদান পাইনি বলে জানা গেছে।

ফুল ভালবাসেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু ফুল চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানো সম্ভব-এব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। তবে ফুল চাষ করে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন একজন সফল ফুলচাষি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিষার ডাইং প্রসাদপাড়ার ইসাহাক আলীর ছেলে জাফর ইকবাল। তিনি রাজশাহীর সফল ফুলচাষি। তার দেখাদেখি ওই এলাকার অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে জসিম ও ওয়াসিম নামের দুইভাই। তবে তিনি জানান এবারে করোনা পরিস্থিতিতে তার লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

ধানের চাষ করে সেচের খরচই ওঠে না। এ সময় শুরু হয় শস্য বহুমুখীকরণের চিন্তা। গত কয়েক বছর থেকে জেলার লাল মাটি খ্যাত বরেন্দ্র গোদাগাড়ীতে চলছে ফুলের চাষ। এখন পর্যন্ত ফুলের চাষ করে লোকসান গুণতে হয়নি কাউকেও। তবে চলমান কোভিড-১৯ ফুলচাষে লোকসান হয়েছে অনেকের। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলেও লকডাউন না থাকায় বর্তমানে আবারো ফুলের চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি ফুল সংশ্লিষ্টদের ভাগ্যের চাকাও ঘুরতে শুরু করেছে।

পবা উপজেলার হরিষার ডাইং প্রসাদপাড়া। অনেক আবাদ করেও লোকসানে পড়তে হয়েছে যুবক জাফর ইকবালকে। শেষ পর্যন্ত তিন বছর আগে মাত্র ১০ কাঠা জমিতে ফুলচাষ শুরু করেন তিনি। আর পিছনে তাকাতে হয়নি জাফর ইকবালকে। এব্যাপারে জাফর ইকবালকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করেছিলেন উপজেলার কাদিপুর ব্লকের উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল হক। ফুলচাষেই ভাগ্য ফিরেছে তার।

গতবছর ফুল বিক্রির লাভ দিয়েই অপরের জমি লীজ নিয়ে ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন বিভিন্ন জাতের ফুল গাছ। গতবছর ফুল থেকে সম্পূর্ণ খরচ বাদ দিয়ে প্রতিবছরই লাভ হয় প্রতি বিঘাতে এক লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। এবারে করোনা ভাইরাসের কারণে ৭ বিঘা জমিতে ফুলচাষ করেছেন তিনি। তার জমিতে রয়েছে রজনীগন্ধা, গোলাপ, চাঁপা গাঁদা, হাজারি গাঁদা, বাসন্তী গাঁদা। এর মধ্যে তিন বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, দুই বিঘা জমিতে গাঁদা ও এক বিঘা জমিতে গোলাপ রয়েছে। স্বল্প পরিসরে রয়েছে স্টার, ডালিয়া, কসমস, চন্দ্র মল্লিকা, বাগান বিলাস। ফুল তোলা ও বিক্রিতে সহযোগিতা করে থাকেন জাফর ইকবালের স্ত্রী নুশরাত জাহান।

বুধবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে জাফর ইকবালের ক্ষেতে সরেজমিন দেখা যায়, জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী নুশরাত জাহান, ছেলেসহ কয়েকজন ফুল সংগ্রহ করছেন। জাফর ইকবাল জানান, বর্তমানে ফুল চাষের চেয়ে লাভজনক ফসল আর নেই। লকডাউনে আমাদের হোচট খেতে হয়েছে। তবে বর্তমানে লকডাউন না থাকায় ফুলের চাহিদা বাড়ছে এবং করোনার লোকসান পুষিয়ে নিতে পারছি। যত দিন যাচ্ছে ফুলের চাহিদা ততই বাড়ছে।

তিনি আফসোস করে বলেন, কোভিড-১৯ আঘাতে ফুলচাষিদের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। ফুলচাষিরা মনে করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে পুরো বছরই অনুষ্ঠান চলবে এবং ব্যাপক ফুল বিক্রি হবে। কিন্তু প্রকৃতি কেড়ে নিয়েছে আমাদের স্বপ্ন। তবে বর্তমান দামেও ফুলচাষিরা লাভের ব্যাপারে আশাবাদি। বর্তমানে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই মাধুর্য্যতা বাড়াতে আনুসাঙ্গিক হিসেবে আয়োজকরা ফুল রাখছেন। বছরের পুরো সময়ই ফুল বিক্রি হয়। তবে বিশেষ দিনগুলো যেমন প্রতিটি জাতীয় দিবস, ঈদ-পূজা ও ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালবাসা দিবসে প্রতিটি ফুলের দাম দ্বিগুন-তিনগুণও বেড়ে যায়। এছাড়াও বিয়েতেও প্রচুর পরিমানে ফুল কিনছেন।

জাফর ইকবাল বলেন, প্রায় ১ বিঘা জমি থেকে প্রতিদিনই ১০-১৪ হাজার গাঁদা ফুল আহরণ করতে হয়। বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি হাজার গাঁদা ফুলের দাম তিনশো’ থেকে চারশো’ টাকা। প্রতিদিন শ্রমিক খরচ বাদ দিয়ে থাকছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আবার জাতীয় দিনগুলোতে প্রতি হাজার বিক্রি হয় পাঁচশো’ টাকায়। তখন আরো বেশী থাকে। পাইকারি বাজারে প্রতিটি গোলাপ ফুল বিক্রি হচ্ছে ৫-৭ টাকা, রজনীগন্ধার স্টিক প্রতিটি ৬-৮ টাকা।

লকডাউনের আগে বছরে প্রতি বিঘা গোলাপ ফুলে এক লাখ টাকা লাভ হয়। আর্থিকভাবে লাভবানতো বটেই ফুল চাষ করে সম্মানও বেড়ে গেছে। ফুল যেহেতু মনের খোরাক ও অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াই সেহেতু ফুল চাষিরাও সম্মানিত হয়। প্রতিদিনই বড়বড় কর্মকর্তা, শিক্ষকরা আমার সাথে কথা বলছেন, ফুল ক্রয়ের বাইনা দিচ্ছেন, ফুল কিনছেন। আবার তার মত অনেকে ফুল চাষে নেমেছেন।

তিনি বলেন, রাজশাহীতে প্রথম গোদাগাড়ী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ শুরু হয়। ফুলের চাষ প্রতি বছরই বাড়ছে। তেমনি চাহিদাও বাড়ছে। তবে এখন পর্যন্ত রাজশাহী জেলায় চাহিদারর তুলনায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন হয়। বাকি ৬০ শতাংশ ফুল যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি করতে হয়। আবার অন্যান্য স্থানের ফুলের মানের চেয়ে রাজশাহীর ফুল অনেক উন্নত।

রাজশাহী নগরীর জিরো পয়েন্টের ফুল বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশের বড় ও মাঝারি শিল্পের মতো ক্ষুদ্র শিল্পগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র শিল্প ও কাঁচা পণ্য হওয়ায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছিল ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা। লকডাউন উঠে যাওয়ায় আবারো ফুলের সাথে জড়িতরা কর্ম ফিরে পেয়েছে এবং ব্যবসায়ী ও ফুল চাষিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি ফুলের চাহিদাসহ দামও বেড়েছে এবং ব্যবসায়ী ও চাষিরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা বলেন, রাজশাহীতে ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা আছে যেহেতু সেহেতু চাষিরা লাভবান হবেন। এই উপজেলাতে দুই একটি মাঠে নতুন করে ফুল চাষে ঝুকেছেন চাষিরা। আগামী আরো বেশী চাষ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুল হক বলেন, প্রচলিত ফসল থেকে বিকল্প ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এ ক্ষেত্রে ফুল চাষে লাভবান হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় ১৬-২০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ রয়েছে।

 

  • 44
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে