দেশীয় প্রাচীন কৃষি উপকরণের সংগ্রহশালা জাহাঙ্গীর শাহের ‘কৃষি জাদুঘর’

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২০; সময়: ৬:০০ অপরাহ্ণ |
দেশীয় প্রাচীন কৃষি উপকরণের সংগ্রহশালা জাহাঙ্গীর শাহের ‘কৃষি জাদুঘর’

নিজস্ব প্রতিবেদক : কাঠের তৈরি প্রাচীন কৃষি উপকরণ ‘আড়ি’।কক্সবাজার এলাকায় এক সময় ধান পরিমাপ করার কাজে ব্যবহৃত হতো এই কৃষি উপকরণ।গোলপাতা দিয়ে তৈরি মাথাল ‘জুমলা’। ফেনী এলাকায় কৃষকরা ব্যবহার করতেন এই কৃষি উপকরণ। সাওতালদের বসার বেড়া ‘গান্ডু’,।ওজন পরিমাপকযন্ত্র পানশারা (কাচির ওজনে পাঁচসেরকে বলা হয় পানশারা)।

অর্ধশত বছর পূর্বেও বহুল প্রচলিত বিভিন্ন জেলার ব্যবহৃত এইসব কৃষি উপকরণকে একসাথে দেখতে পাওয়া যাবে জাহাঙ্গীর আলম শাহের কৃষি জাদুঘরে।নওগাঁর মান্দার প্রত্যন্ত গ্রাম কালিগ্রামে পেত্রিক ভিটাতে ব্যক্তিগত ‍উদ্যোগে ২০০৮ সালে এই কৃষি জাদুঘর গড়ে ‍তুলেছেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ।তিনি রাজশাহীর সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বাইরে কালিগ্রামের পৈত্রিক ভিটায় ১২ বছর ধরে গড়ে তুলেছেন কৃষি উপকরণের সংগ্রহশালা।

জাদুঘরে রয়েছে দড়ি পাকানোর ট্যাকরাস, গরু টানা জোয়াল, বক ধরা ফাঁদ, ঢ্যাল ভাঙ্গা হাতুড়ি, ঘানি ভাঙ্গা জ্যাট, আটা পেষা জাতা ও তেল পেষা জাতা, ডাল ভাঙা জাতা, তেল তোলা ওড়ং, তেল মাপা চোঙ্গা, বিভিন্ন এলাকার মাটি, উইয়ের মাটি, আদিবাসীদের ফসল তোলার ঝুরি, ধান ভাঙ্গা ঢেঁকি, জমির মাটি আলগা করার নাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন কৃষি উপকরণ।হলরুমের মতো বড় একটি কক্ষে স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে এইসব কৃষি উপকরণ।পরিমাপ, ভাঙ্গা, নিড়ানী–এভাবে ৫০টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে রাখা হয়েছে কৃষির উপকরণগুলো।বাদ যায়নি কৃষকদের ব্যবহৃত নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের উপকরণও ।

জাদুঘরের মূল ভবনের বাইরেও মাটির বাড়ির বারান্দায় স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে আনা কৃষি উপকরণ।

জাহাঙ্গীর আলম শাহ জানান, ২০১৮ সালে কক্সবাজার থেকে তিনি ধান মাপার যন্ত্র ‘আড়ি’ স্থানীয় এক বাসিন্দার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন।এই ধান মাপার আড়ির বয়স ৯৫ বছর।আর ২০১১ সালে ফেনীর আলমগীর নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন গোলপাতার তৈরি মাথাল।
জাহাঙ্গীর শাহ জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এইসব কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়েছে।এইজন্য অনেক অর্থ ও শ্রম দিতে হয়েছে।সবসময় চেষ্টা করেছি বিভিন্ন জেলার স্থানীয় কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করতে। এখনো বহু কাজ বাকি রয়েছে।এখনো অনেক জিনিস সংগ্রহ করার বাকি রয়েছে।

শুরুর কথা : জাহাঙ্গীর শাহকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক একটি কৃষি বিষয়ক বই উপহার দেন। ওই বই পাওয়ার পর তার কৃষি লাইব্রেরি গড়ে তোলার ভাবনা মাথায় আসে। একটা দুইটা বই সংগ্রহ করতে করতে গড়ে তুলেন শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার। এই পাঠাগার তৈরি করতে গিয়েই তার মাথায় দেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করার চিন্তা মাথায় আসে।তারপর থেকে বিভিন্নজনের সহযোগিতা ও নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করতে শুরু করেন।

জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, লাইব্রেরি করতে গিয়ে মাথায় আসে যে শুধু কৃষি লাইব্রেরি গড়ে তুললে হবে না সাথে কৃষির উপকরণও সংগ্রহ করতে হবে। কৃষি লাইব্রেরি কৃষকদের মান্নোয়নে ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।আর কৃষি জাদুঘর নতুন প্রজন্মকে আমাদের কৃষির আদি উপকরণ সম্পর্কে পরিচিত করতে সহায়তা করছে।

কৃষি লাইব্রেরি : জাদুঘর গড়ে তোলার আগেও কৃষি লাইব্রেরি গড়ে তুলেন জাহাঙ্গীর শাহ।বর্তমানে তার শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারে ৬ হাজারের অধিক কৃষি বিষয়ক দুর্লভ বই-পুস্তক রয়েছে। যেখানে কৃষকরা এসে বই পড়েন। পাঠাগারে কৃষি কবিতার চর্চাও হয় ।এছাড়া তিন বিঘার পৈত্রিক বাড়িতে রোপন করেছেন ২৫০টি ওষুধি গাছ ও ৪৪ টি ফলের গাছ।কৃষি পঞ্জিকা নামে বইও লিখেছেন তিনি।কৃষি বিষয়ক আরো কয়েকটি বই তার প্রকাশের অপেক্ষায়।

গুণী এই ব্যক্তি কৃষিক্ষেত্রে অনবদ্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু জাতীয় ‍কৃষি পদকসহ অসংখ্য স্থানীয় ও জাতীয় পদক পেয়েছেন।
জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, কৃষি পাঠাগারের উদ্যোগে কৃষকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ট্রেনিং দেওয়া হয়।এছাড়া কৃষি বিষয়ক সেমিনারের আয়োজনও করা হয়।লাইব্রেরিতে এসে কৃষকরা বই পড়ে উপকৃতও হন।

এই জাদুঘর ও পাঠাগারে গবেষণা করতে এসেছেন দেশে-বিদেশের গবেষকরা। পরিদর্শনের জন্য দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কৃষকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষজন। পাঠাগার ও জাদুঘর থেকে নিয়মিত কৃষকদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর ফলে কৃষকরাও নিজেদের বিকশিত করতে পারছেন।
শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও জাদুঘরকে বাংলাদেশের একমাত্র কৃষি জাদুঘর বলে মত দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত মঙ্গলবার রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা থেকে স্বস্ত্রীক জাদুঘর ও লাইব্রেরি দেখতে গেছেন কৃষক সাইদুর রহমান। তিনি জানান, আমিও জমিতে নতুন নতুন ফসল চাষাবাদ করি।আমার যে শিক্ষা আছে কৃষক হিসেবে, তার চেয়ে আরও বেশি কিছু শিখতে জাদুঘর ও লাইব্রেরি দেখতে এসেছি।

গৃহবধূ মিথিলা আক্তার রাজশাহী থেকে গেছেন জাদুঘর পরিদর্শনে। তিনি জানান, এই ধরনের জাদুঘর প্রতিটি জেলায় স্থাপন করা উচিত। এর ফলে নতুন প্রজন্ম আদি কৃষি উপকরণ সম্পর্কে জেনে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। আমি নিজেই এই জাদুঘর ও লাইব্রেরি দেখে মুগ্ধ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এরকম একটি জাদুঘর সত্যিই দেখার মতো।

কালিগ্রাম গ্রামের কৃষক হজরত আলী ও জয়নাল জানান, কৃষি লাইব্রেরি ও জাদুঘর দেখতে বিভিন্ন কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আসেন। তাদের সাথে আমাদের গ্রামের কৃষকদের মতবিনিময় করার সুযোগ ঘটে। এছাড়া জাহাঙ্গীর শাহ নিজেও কৃষকদের জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এইসব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকরা দক্ষতাসম্পন্ন কৃষক হয়ে গড়ে উঠছেন। এছাড়া কৃষি লাইব্রেরি পড়ালেখার মাধ্যমে দক্ষতাসম্পন্ন কৃষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার বলেন, আমি দেশের ৬৪টি জেলার ৪৬০টি থানা ঘুরে দেখেছি। এইরকম কৃষি জাদুঘর বাংলাদেশের কোথাও দেখিনি। এই জাদুঘর একটি অনন্য জাদুঘর। এইরকম জাদুঘর আমি শুধুমাত্র ফিলিপাইনে দেখেছি।তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই বলা যায়, সরকারি উদ্যোগে এইরকম একটি কৃষি জাদুঘর গড়ে তোলা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের জন্য এখনো তার উদ্বোধন হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই জাদুঘর আরো সম্প্রসারিত ও বর্ধিত করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে