রাজশাহীতে টিএসপি সংকটে বিপাকে আলু চাষিরা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২০; সময়: ১০:০৯ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে টিএসপি সংকটে বিপাকে আলু চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : চাহিদার তুলনায় সরকারিভাবে বরাদ্দ কম থাকায় টিএসপি সারের ঘাটতির আশংকা দেখা দিয়েছে। চাহিদা থাকায় এরই মধ্যে সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় দ্বিগুন দামে বিক্রি হচ্ছে টিএসপি। আবার দ্বিগুন দামেও চাহিদামত পাওয়া যাচ্ছে না এই সার। বাজারে সার না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিকসহ ব্যবসায়ী কাম আলু চাষিরা। এই জেলায় টিএসপি সারের দাম বাড়ায় সরকারসহ নীতি নির্ধারকগণকে দুষছেন তারা।

এবারে রাজশাহী জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর (প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার ৫শ’ বিঘা)। আলুর জমি প্রস্তুতকালেই চাষিরা প্রতিবিঘা জমিতে এক বস্তা টিএসপি সার দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এই জেলায় শুধুমাত্র আলুচাষেই টিএসপি সারের প্রয়োজন প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার ৫শ’ বস্তা (প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি)। অথচ এই জেলায় সারা বছরের টিএসপি সারের সরকারি বরাদ্দ ৮ হাজার ৪১৮ টন। অর্থাৎ এক লাখ ৬৮ হাজার ৩৬০ বস্তা। এতে আলুচাষেই টিএসপি সারের ঘাটতি থাকছে ৯৪ হাজার ১৪০ বস্তা। আবার এই জেলায় ডিএপি সারের বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাজারে টিএসপির সাথে সাথে ডিএপি সারেরও দাম বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছে চাষিরা। একদিকে বরাদ্দ কম এবং অন্যদিকে চাহিদা থাকায় প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে টিএসপি সার। আবার টিএসপির পাশাপাশি ডিএপিও চাহিদা মত পাওয়া যাচ্ছে না।

আলু রাজশাহীর অর্থকরী ফসল। ধানের পরেই ব্যাপকভাবে আলুর আবাদ হয়ে থাকে। মৌসুমের শুরু থেকে আলু দাম ভাল ছিল। এতে চাষিরাও খুশি হচ্ছেন। এবারে করোনা সংকট ও অতিবৃষ্টিকে পুঁজি করে আলু চাষি কাম ব্যবসায়ীরা অনেকটা অনাকাঙ্খিতভাবে বেশী দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। সরকারের হস্তক্ষেপেও দাম এখনো অনিয়ন্ত্রিত। এই অবস্থাতে আবারো আলু রোপনের মৌসুম শুরু হয়েছে। খুবই কম সময়ের মধ্যে জেলায় ব্যাপক জমিতে আলু চাষ হয়ে থাকে। এ জন্য দেখা দেয় হুড়াহুড়ি পাড়াপাড়ি। অনেকটা একই সঙ্গে রোপন করা হয় বলে গ্রামের চাষি পরিবারে দম ফেলার সময় থাকে না।

বর্তমানে অবাদ মানেই রাসায়নিক সারের ব্যবহার। খুবই অল্প সময়ে অধিক রাসায়নিক ব্যবহার হয় এই মৌসুমে। তবে টিএসপি ও ডিএপি রাসায়নিক সার সংকটে ভূগছে চাষিরা। বরাদ্দ কমের জন্য বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে তাদের। এমনকি সার পেতে অনেকে হন্যে হয়ে ঘুরছেন তারা। বাজারে সবোর্চ্চ এক হাজার টাকা বস্তার টিএসপি বিক্রি হচ্ছে ১৫শ’ থেকে সাড়ে ১৬শ’টাকায়। ডিএপিও বিক্রি হচ্ছে বেশী দামে। আলু, পেঁয়াজ, রসুনসহ রবি মৌসুমের চাষিরা বিপাকে পড়েছে সার নিয়ে। বিশেষ করে আলু চাষে টিএসপির ব্যাপক ব্যবহার থাকায় সার নিয়ে হোছট খাচ্ছেন তারা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ডিএপি সারের দাম বাড়িয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা বলে অভিযোগ উঠেছে।

আলু চাষে এবছর লাভ হলে আগামী বছর লোকসান। লাভ লোকসানের দুরাচলের মধ্যে দিয়েই আশায় বুকবেধে আলুর আবাদ করে চলেছেন চাষিরা। গেলো কয়েক বছর ধরেই আলুতে লোকসান গুনেছেন রাজশাহী জেলার চাষি। এবারে উঠতি মৌসুমে বাজারে আলুর দাম ভাল থাকায় কৃষকরা লাভবান হয়েছেন। তবে বেশীরভাগ লাভ জমা হয়েছে আলু চাষি কাম ব্যবসায়ী অর্থাৎ হিমাগারে রক্ষিত আলু ব্যবসায়ীর ঝুলিতে। এরপরেও প্রান্তিক কৃষকরাও ব্যাপক জমিতে আলু চাষ করে থাকেন। সারের দাম বেশী হওয়ায় প্রান্তিক চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে টিএসপি সারের বাড়তি দামের জন্য সরকারকে দুষছেন তারা।

চাষিদের ভাষ্য, আলুতে যেমন ব্যাপক লাভ, তেমনি লোকসানের ধ্বসও কম নয়। আলুর আবাদে কারো কারো ভাগ্যে বৃহস্পতি দেখা দিলেও অনেকের ভাগ্যে জুটেছে মৃত্যু। বর্তমানে আলুর আবাদের উৎপাদন খরচ বেশী হলেও দাম ভাল। তবে এই আবাদ প্রান্তিক চাষিদের নেই বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। এখন চাষি কাম ব্যবসায়ীরাই আলুর আবাদ করছেন। লাভ লোকসান মাথায় নিয়ে প্রতিবছরই লাভের আশায় চাষে নামছেন তারা। বর্তমানে দাম আকাশ ছোয়া হওয়ায় আলু চাষিদের মাঝে খুশির জোয়ার বইছে। তবে সার সংকটে দেখা দিয়েছে হতাশা।

জেলার মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের নুড়িয়াক্ষেত্র এলাকার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আলু চাষ করেন মোবারক হোসেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে আলুচাষ করছেন তিনি। এবারো ৫০ বিঘা জমিতে আলুচাষ করেছেন তিনি। তিনি জানান, চাহিদা মত পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় এবারে টিএসপি সারের দাম বেড়েছে। আর এই সুযোগে সার না পাওয়ার অজুহাতে ডিএপিসহ অন্যান্য সারের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন ডিলারগণ। তবু চাহিদা মত পাওয়া যাচ্ছে না। এবারে আলুর দাম বৃদ্ধিতে সরকার দাম নির্ধারণ করেছেন। আমরা তা মেনে নিয়েছি এবং সরকারি দামেই বিক্রি করেছি। কিন্তু সারের অভাবে আলু যদি না রোপন করতে পারা যায় তবে আলু উঠতিকালেও দাম কমবে না।

আলু চাষ করে বরাবরই বৃহস্পতির দেখা পেয়েছেন মৌগাছি গ্রামের নুরুল ইসলাম। তিনি প্রতিবছরই কয়েকশো বিঘা আলু চাষ করে থাকেন। তিনি বলেন, টিএসপির পাশাপাশি ডিএপি সারও প্রতিবস্তা ১১ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। ডিলারের দোকানে সরকারি দামের ফর্দ টাঙ্গানো থাকলেও মাল পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি খুব দ্রুত টিএসপি ও ডিএপি’র বরাদ্দ বাড়িয়ে সরবরাহের আবেদন করেন। নইলে সারের প্রাপ্যতার জন্য আলু চাষ ব্যাহত হবে আশংকা করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিলার বলেন, টিএসপি সারের এমনিতেই বরাদ্দ কম। কিন্তু এই জেলার বেশীরভাগ আলু চাষি প্রতি বিঘা জমিতে এক বস্তা টিএসপি, এক বস্তা ডিএপি এবং ১-২ বস্তা এমওপি দিয়ে থাকেন। সেই ক্ষেত্রে বিশেষ করে টিএসপির ঘাটতি হবেই। তিনিও বেশী বরাদ্দের দাবি জানান।

পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা বলেন, গতবছরের চেয়ে এ বছর সরকারিভাবে প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ টিএসপি সারের। সেক্ষেত্রে ডিএপির বরাদ্দ বাড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের চাষিরা বিশেষ করে আলু চাষে ব্যাপক পরিমানে টিএসপি সার ব্যবহার করেন। একদিকে বরাদ্দ কম এবং অন্যদিকে একসাথে রোপনের ফলে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিতে পারেন। এসব সারে বেশী দাম নিচ্ছেন ডিলারগণ-এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই মনিটরিং করছি। তবে চাহিদা থাকায় দু’একটি ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন রাজশাহী ইউনিটের সভাপতি আলহাজ্ব ওছমান আলী ও সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, শুধু টিএসপি, ডিএপি নয়, কোন ধরণের রাসায়নিক সার সরকার নির্ধারিত দামের বেশী নেওয়ার এখতিয়ার নাই। তবে তারাও দাবি করেন আলু মৌসুমে টিএসপি সারের বরাদ্দ বাড়াতে। তারা বলেন, খুচরা বিক্রেতারা কিছু বেশী নিতে পারেন-যা আমরা খবরদারি করতে পারব না। কোন ক্রমেই বিসিআইসি ডিলারগণ সরকারি মূল্যের বেশী দামে সার বিক্রি করতে পারবেন না। কোন ডিলার যদি প্রমান সাপেক্ষে বিক্রি করেন তবে তার ডিলারশীপ বাতিল হয়ে যাবে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুল হক বলেন, এই অঞ্চলের মাটি আলু চাষের উপযোগী। তাই আলুর সময়ে সার নিয়ে কিছুটা হলেও বিড়ম্বনা দেখা দেয়। আর এইটার কারণ হলো- বেশীরভাগ চাষিই একসাথে সার ক্রয় করার জন্য। মনে করেন একজন কৃষক এবারে ২০ দিনে ৫ বিঘা আলু করবে। কিন্তু তিনি সার কিনবেন একদিনে। এ জন্য কিছুটা সংকট দেখা দেয়। তিনি যদি কৃষি ক্রমান্বয়ে সার কিনতেন তবে সংকট থাকতো না।

তিনি আরো বলেন, এবারে টিএসপি সারের বরাদ্দ কমিয়ে ডিএপি সারের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অনেক চাষি মনে করেন ডিএপি দিলে আলু শিকড় পচে যেতে পারে। এই ধারণাটি একবারে ভুল। তিনিও সারের দাম বাড়তি বিষয় অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যদি এমন হয় সারের জন্য আলু রোপন ব্যাহত হচ্ছে তবে তিনি বাড়তি বরাদ্দ চাইবে। তবে সে সময় এখনো আসেনি। আমরা কষি নিয়ে কাজ করি। কৃষকের সার্থই সরকারের সার্থ। কৃষকের সেবা ও দেখভালের জন্য আমরা নিয়োজিত।

  • 88
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে