ইউসুফ মোল্লার ধানবীজ চাষাবাদ করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক, হচ্ছে গবেষণাও

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২০; সময়: ৬:১৭ অপরাহ্ণ |
ইউসুফ মোল্লার ধানবীজ চাষাবাদ করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক, হচ্ছে গবেষণাও

নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর গ্রামের কৃষক ইসলাম মোহাম্মদ। তিনি রাজশাহীর ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে ৬০ প্রকারের ধানবীজ সংগ্রহ করে তার জমিতে চাষাবাদ করছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে বলেন, ধানের আদি বীজকে মাঠে রক্ষার জন্য আমরা কাজ করছি। আমি যেমন ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে বিলুপ্ত জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেছি, একইভাবে আমি নিজেও ১০/১২টি আমাদের স্থানীয় আদি ধান বীজ তাকে সরবরাহ করেছি। কারণ আমরা চাই, মাঠে ধানবীজ সুপ্ত অবস্থায় টিকিয়ে রাখতে। এটাকে আমরা আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। যাতে আমাদের মাটির আদি বীজ হারিয়ে না যায়।

ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে ২৬ প্রকার ধান বীজ নিয়ে চাষাবাদ করেছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সৈয়দপুর গ্রামের কৃষক খন্দকার আবদুল মুকিদ। তিনি বলেন, ‘‘আমি মোট ৩৫ বিঘা জমিতে ধান চাষাবাদ করি। এর মধ্যে ১৫ বিঘা জমিতে ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে নিয়ে আসা বিলুপ্ত জাতের ধান চাষাবাদ করেছি। ওইসব ধানের ফলন কম। কোনোটাতে পেয়েছি ৮ মণ, কোনোটাতে পাঁচ মণ, কোনোটাতে ৭ মণ করে। বীজ রেখে দিয়েছি যেন আগামী বছর আবার চারা করে চাষাবাদ করা যায়। এই ধান চাষাবাদের একটাই লক্ষ্য আদি ধানবীজ রক্ষা করা”।

শুধু তারাই নন, ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে বীজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, নরসিংদী, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, বগুড়া, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় হাজারখানেক কৃষক।
তবে কৃষকদের ধানবীজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার শর্ত একটাই, যে পরিমাণ ধানবীজ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে, তার দ্বিগুণ পরিমাণ ধানবীজ তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

সংগ্রহকৃত ধান বীজ টিকিয়ে রাখার জন্য ইউসুফ মোল্লা নিজেও তার দেড়বিঘা জমিতে অল্প অল্প করে প্রতিবছর ৯৬ জাতের ধান চাষাবাদ করেন।

তার কাছ থেকে বীজ নিয়ে এসেছে চাষাবাদ করছেন রাজশাহী তানোরের জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘‘ইউসুফ মোল্লার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান বীজ সংগ্রহ করা। যখন যেখানে খোঁজ পান, সেখানেই ছুটে যান। তার চেষ্টায় দেশের একমাত্র বীজ ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। তার কাছ থেকে আমি নিজেও কিছু বিলুপ্ত জাতের বীজ নিয়ে এসেছি।’’

শুধু তারাই নন, ইউসুফ মোল্লার সংগৃহিত ধানবীজ নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট গবেষণা করছে। তার ধানবীজ নিয়ে দেশের অনেক মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে ১০০ জাতের ধানবীজ নিয়ে গবেষণা করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪০ প্রকারের ধানবীজ নিয়েছে গাজীপুরের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ঈশ্বরদী নিয়েছে ২৯ প্রকার ধানবীজ, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৭ প্রকার ও রাজশাহী ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ৪০ প্রকার জাতের ধানবীজ নিয়ে গবেষণা করছে। এর মধ্যে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউসুফ মোল্লার ৩০০ প্রকার ধানবীজ নিয়ে মিউজিয়াম করবে। এছাড়া টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরে ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে নেওয়া ১৪০ জাতের ধানবীজ জাদুঘরে সংরক্ষিত করে প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল মতিন জানান, ‘‘আমি ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে প্রায় ১০০ জাতের ধানবীজ নিয়ে এসেছি। সেখান থেকে আমি গবেষণা করে দেখছি, সেই ধানবীজ থেকে কীভাবে আমরা উপকার পেতে পারি। কীভাবে ধানবীজের সংকরায়ন করে খরা সহিষ্ণু জাত আবিষ্কার করা যায় সে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে”।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দুবইল। ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী মোল্লা। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মনের বয়স বাড়েনি এতটুকু। এই বয়সে এখনো ছুটে বেড়ান বিলুপ্ত জাতের ধান বীজ সংগ্রহে। দেশের যে প্রান্তেই খবর পান বিলুপ্ত জাতের ধান সংগ্রহে ছুটে যান তিনি। এভাবেই সংগ্রহ করেছেন দেশীয় বিলুপ্ত জাতের ৩০০’র মতো ধান বীজ। শুধু সংগ্রহই করেননি, সেই ধান দিয়ে তৈরি করেছেন দেশের একমাত্র ‘ধানবীজ ব্যাংক’ ও ‘ধানবীজ লাইব্রেরি’।

ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের পাশাপাশি কৃষকদের মাঝে তিনি সেই বীজ বিতরণ করেছেন। এছাড়া প্রতিবছর ডিসেম্বরে প্রায় আড়াই শতাধিক কৃষকদের নিয়ে জাঁকজমকভাবে উদযাপন করেন নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব ‘নবান্ন উৎসব’। ধানবীজ ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের দেন সম্মাননা পুরষ্কারও। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নিজেও পেয়েছেন জাতীয় পরিবেশ পদক। তার কাছ থেকে বিলুপ্ত জাতের ধান নিয়ে গবেষণা করেছেন দেশের নামকরা গবেষণা সংস্থা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

তানোর উপজেলা থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে দুবইল গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে দেশের একমাত্র ধানবীজ ব্যাংক ‘বরেন্দ্র ধানবীজ ব্যাংক’। সেখানে স্থাপিত পাকা তিনটি কক্ষের মধ্যে একটি রুমে তৈরি করা হয়েছ ধানবীজ ব্যাংক। কক্ষের তালা খুলে দেখা গেল, রুমের একদিকের দেয়ালজুড়ে তিনটি তাকে সারি সারি করে রাখা এক একটি কাঁচের বয়ামে আছে এক এক জাতের ধানের বীজ। কোনোটির বয়াম ভর্তি, আবার কোনো বয়ামে রয়েছে বিভিন্ন জাতের অল্পকিছু বীজ। বয়ামের গায়ে সাদা কাগজ দিয়ে সেঁটে দেওয়া আছে প্রত্যেকটি ধানবীজের নাম। সতিন, ঝিঙ্গাসাইল, দাত খানি, রাঁধুনী পাগলা, বাদশা ভোগ, চিনি শংকর, সিব জটা, বান কলম, ঝগড়া সাইল, রানার সাইল, অহনাসহ নাম না জানা অনেক ধানবীজ।

ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, ‘এক একটি বীজ সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। দেশের যে প্রান্ত থেকে বিলুপ্ত জাতের ধানবীজের সন্ধান পেয়েছি, সেখানেই ছুটে গেছি। এভাবে গত ৫০ বছর ধরে বিলুপ্ত জাতের এই ধানবীজ সংগ্রহ করেছি।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার কাছে এমনও ধানবীজ রয়েছে যার বয়স ১০০ বছর পার হয়ে গেছে। যেমন, সোনাকাঠি নামের একটি ধানবীজ রয়েছে যেটি বাংলা ১৩৩৪ সালের দিকে পাওয়া যেতো। বর্তমানে আমার কাছে ৩০০ জাতের ধানবীজ রয়েছে। যার মধ্যে ১৫০ জাতের বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি ১৫০ জাতের এখনো অঙ্কুরোদগম হয়। আমি নিজেও এ বছর দেড়বিঘা জমিতে ৯৬ জাতের ধান চাষাবাদ করেছি।’’

শুরুর কথা
১৯৬৮ সালে বিয়ের পর ইউসুফ মোল্লা দেখতে পান একের পর এক নতুন ধান আবিষ্কৃত হচ্ছে। কৃষকরা তখন ঐতিহ্যবাহী দেশি ধানের আবাদ বাদ দিয়ে উদ্ভাবিত নতুন ধানের চাষাবাদ শুরু করেন। তখন তার শঙ্কা হয়, একটা সময় আসবে যখন হয়তোবা এসব নানা জাতের ধানের বীজ আর পাওয়া যাবে না। তখনই তিনি দেশীয় ঐতিহ্যবাহী ধানবীজ সংগ্রহের পণ করেন। প্রথমে মাটির হাঁড়িতে, পরে কাচের বয়ামে সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তবে তাকে তখন এ কাজে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সোহেল রানা নামে তার এক বন্ধু। তার বন্ধুই তাকে শিখিয়েছেন কীভাবে বীজ সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়।

আর্থিক সংকট ও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মাত্র ৬০ ধরনের বিলুপ্ত জাতের ধানবীজ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ২০১২ সালে পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজের (বারসিক) সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকেই তারা তাকে এ কাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে আসছেন। কোথাও বিলুপ্ত জাতের ধানবীজের সন্ধান পেলে তারাই সেসব বীজ সংগ্রহে যাওয়ার আসার অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন। তাদের সহযোগিতায় ২০১৫ সালে দুবইলে প্রতিষ্ঠা পায় ‘বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক’ ও তালন্দ আনন্দমোহন উচ্চবিদ্যালয়ে স্থাপিত হয় ‘ধানের বীজের লাইব্রেরি’। ইউসুফ মোল্লা ও বারসিকের দাবি, এই ধানবীজ ব্যাংক ও লাইব্রেরি দেশের মধ্যে প্রথম।

ইউসুফ মোল্লা বলেন, ১৯৬৭ সাল থেকেই উদ্ভাবিত ইরি-৮ ধানের আবাদ শুরু হয়। কৃষকরা তখন দেশি জাতের ধান বাদ দিয়ে উদ্ভাবিত নতুন ধানের চাষ শুরু করে। এরপর এলো ইরি-২০। তখন কৃষকরা ইরি-২০ ধান চাষাবাদ করতে শুরু করেন। এসব দেখেই আমার মনে হয়, ‘‘দেশি ধান একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’’

তিনি বলেন, আমি নিজেও কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবাকে যেসব ধান চাষাবাদ করতে দেখেছি, কয়েক বছরের ব্যবধানে দেখলাম সেইসব ধান আর কেউ চাষ করছে না। এসব দেখেই আমার ভেতরে ইচ্ছা জাগে বিলুপ্ত জাতের ধান বীজ সংগ্রহের। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, দেশের যে প্রান্তে ধান বীজের খোঁজ পেয়েছি, সেখানেই ছুটে গেছি। এইভাবেই রংপুরে গিয়ে পেয়েছি, ‘কালো বকরি’ ও ‘সাদা বকরি’ নামের ধানবীজ। আমার কাছে এমন ধানের বীজ আছে যার চালও কালো, ভাতও কালো হয়।

ধানবীজ সংরক্ষণের বিষয়ে ইউসুফ মোল্লা জানান, ধানবীজ ব্যাংকে যেসব বীজ রয়েছে সেসব অঙ্কুরোদগমন হয়না। সেসব শুধু পরিদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। তবে আমার কাছে যে ৩০০ জাতের ধানবীজ রয়েছে তার মধ্যে ১৫০ জাতের অঙ্কুরোদগমন হয়। সেসব ধানবীজ বস্তায় যত্ন করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ১৫০ জাতের ধানের মধ্যে আমি ২৫ জাতের ধানবীজ চাষাবাদ করছি। বাকি জাতের ধানবীজ আমার কৃষকদের মধ্যে সমপরিমাণ ধানবীজ দেওয়ার সত্ত্বে চাষাবাদ করার জন্য বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। তারা ধানবীজ বপন করে চাষাবাদ করে। চাষাবাদ করার পর আমাকে আবার তারা সমপরিমাণ ধানবীজ সরবরাহ করে। এভাবেই প্রধানত ধানবীজ সংরক্ষণ করা হয়।

তবে বয়ামের বীজগুলো প্রতিবছর একবার করে রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হয় বলে জানালেন ইউসুফ মোল্লা।

তিনি বলেন, বয়ামের বীজগুলো ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে রাখা হয়েছে। এখনো পচেনি। তবে প্রতিবছর একবার রোদে শুকাতে দিতে হয়। এছাড়া টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বীজ সংরক্ষণের জন্য মেডিসিন পাঠাতে চেয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে পাঠাতে পারেনি।

ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, আমি তো চিরদিন বেঁচে থাকবো না। তাই আমি চেষ্টা করছি এমন কৃষক তৈরি করতে যারা আমার অবর্তমানে ধানবীজ ব্যাংক দেখাশোনা করবে। এইজন্য এই করোনাকালেও আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের সাথে যোগাযোগ করা ও তাদের সাথে গিয়ে দেখাসাক্ষাত করার কাজটিও করতে হচ্ছে।

বারসিকের বরেন্দ্র অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুবান্ধব ও পরিবেশ সহনশীল স্থানীয় যেসব জাত রয়েছে সেসব রক্ষায়ও সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ এইসব জাত যেমন আমাদের পরিবেশের বৈচিত্র্যতা ধরে রাখে ঠিক একইভাবে সুস্বাদু খাবারের স্বাদও দেয়। শুধু উৎপাদনের কথা বিবেচনা না করে এইসব জাতকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের নেওয়া উচিত’।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে