বরেন্দ্রে কৃষকের স্বপ্নের ফসল যাচ্ছে ইঁদুরের পেটে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২০; সময়: ১১:১০ অপরাহ্ণ |
বরেন্দ্রে কৃষকের স্বপ্নের ফসল যাচ্ছে ইঁদুরের পেটে

আসাদুজ্জামান মিঠু : চলছে আশ্বিন মাস। সবুজে সবুজে ভরে উঠছে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠ। সেই সঙ্গে রঙিন হয়ে উঠছে প্রান্তিক কৃষকের স্বপ্ন। মাঠজুড়ে এখন সবুজ স্বপ্নের ছড়াছড়ি। এমন সময় আমনের শেষ মুহুর্তে ক্ষেতের কাচা ধান কেটে সাবাড় করে ফেলছে ঈঁদুরের দল। ইঁদুরের আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে কৃষকেরা।

বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা জানান, আমনের মাঝামাঝি সময় এসে গোড়া পচনসহ নানা রোগ ব্যাধিতে ভরপুর ছিল। অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে কিছুটা কমেছে। তার পরে শুরু হয়েছে ইঁদুরের অত্যাচার। ক্ষেতে বিষ মাখা বিভিন্ন পদ্ধতিতে টোপ, আতব চালের টোপ কিংবা ফাঁদ পেতেও কোন প্রতিকার মিলছেনা।

ক্ষেত থেকে ইঁদুর দুর করতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। তাই সরকারকে ঈদুর দমনে নতুন প্রদ্ধতি আবিস্কার করতে হবে। যেন সকল কৃষক ঈঁদুর থেকে রক্ষা পাই। না হলে ক্ষেতের অর্ধেক ফসল ঈঁদুরের পেটে চলে যাবে। লোকসানে পড়বে প্রান্তিক কৃষকেরা।

রাজশাহী জেলা উপজেলা ও মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা জানান, শুধু বিষ টোপ নয়, কলাগাছ, লাঠি কিংবা বাঁশের কঞ্চিতে পলিথিন বেঁধে দিলে ও রাতে ফসলের ক্ষেতে টায়ার পোড়ানোর পদ্ধতি ব্যবহার করলে ইঁদুর কিছুটা ভয়ে ক্ষেত ছেড়ে চলে যাবে। কৃষকদের দেয়া হচ্ছে পরামর্শ।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার ৩৮৭ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে পোকা দমনের পদ্ধতিতে পার্চিং-লগ, লাইন এবং ধোঁনছা গাছ লাগানো হয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এছাড়াও রাজশাহী অঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আমন চাষাবাদ হবে ৩ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরের উপরে।

গবেষণা

ইঁদুরের দ্বারা দেশে বছরে ক্ষতি হয় ৭০০ কোটি টাকারও বেশি ফসল। ২০১৪-১৫ সালে ইঁদুর দ্বারা মোট ৭২৩ কোটি ৭২ লাখ ৭ হাজার ৩৫৫ টাকার শুধু ধান, চাল ও গম ফসলের ক্ষতি হয়েছে। রাজশাহী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কর্মকর্তা কৃষি বিশেষজ্ঞ ড.রফিকুল ইসলাম সম্প্রতি সময়ে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।

আন্তজার্তিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৩ সালের এক গবেষণার উদাহরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। তাই ইঁদুর প্রতিহত করতে সরকারসহ কৃষকদের সচেতন হবে। যদিও গবেষণাটি সাত বছর আগের। বর্তমানে ২০২০ সালে ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণটি নির্ধারণ করলে আরো দ্বিগুণ হবে বলে সংশিষ্টরা মনে করছেন।

বরেন্দ্রের উচু নিচু পটভূমি হিসাবে পরিচিত রাজশাহী গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা। এ দুই উপজেলায় বন্যার ও অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতেও জলাবদ্ধতা হয়না। তাই ধানসহ যে কোন ফসলের উপযোগি। এবছর দুই উপজেলায় প্রায় ৯৫ ভাগ জমিতে আমন ধান চাষাবাদ হয়েছে। আর প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কৃষকের জমিতে কিছু না কিছু কাঁচা ধান কেটেছে ইঁদুর।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা পাকড়ি ইউপির মোত্তজাপুর গ্রামের কৃষক হাসিম আলী। চলতি বছর অন্যের চার বিঘা জমি বর্গা নিয়ে আমন চাষাবাদ করেছেন। এ বছর বাজারে ধানের দান দেখে মনে অনেক স্বপ্ন ছিল। হয়তো এবার লাভের পাল্লা ভারী হবে। কিন্ত তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে ইঁদুরের দল। তার চার বিঘা আমন ক্ষেতের প্রায় ১৫ শতক কাচা ধান কেটে সাবাড় করে দিয়েছে ইঁদুর। এতে করে তার ২০ মণ ধান কম হবে বলে জানান তিনি। একই গ্রামের কৃষক জোনায়েত আলীসহ আরো ১০-১৫ জন কৃষকের কাঁচা ধান কেটে সাবাড় করেছেন ইঁদুরের দল।

তানোর উপজেলার পাঁচন্দর স্কুলপাড়া গ্রামের কৃষক ডাবলু জানান, চলতি মৌসুমে অন্যের ৬ বিঘা জমি বর্গা আমন চাষ করেছেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় এক ১০ থেকে ১৫ শতক মত কাঁচা ধান কেটে ফেলেছে ঈদুর। রাতে ক্ষেতের পাশে পুরনো টায়ার পুড়ানো, পটকা ফোঁটানো, বিষ টোপ ব্যবহার করা করেও ইঁদুর দমন করা যাচ্ছেনা। ধান ঘরে তুলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।

একই গ্রামের ইঁদুরে ক্ষতিগস্থ কৃষক হুমায়ন কবির, জামিনুর ও রয়েল বলেন, তারা এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ গ্রহন করে ইঁদুর দমন করতে পারছেনা। ইঁদুরের এমন সমস্যা শুধু দুই/চারজন কৃষকের একাই নয়, রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে চলতি আমন মৌসুমে অন্যসব বছরের চেয়ে এবার ইঁদুরের আক্রমণে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা হাজার হাজার কৃষকের কাঁচা-আধাপাকা ধান কেটে সাবাড় করে ফেলছে।

এসব বিষয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের কাছে সম্প্রতি মোবাইল ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা ইঁদুর কিভাবে দমন করতে হয় সেটা জানেন। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকের সাথে কাজ করছেন।

গোদাগাড়ী উপজেলার অনেক কৃষকের আমন ক্ষেতে কাঁচা ধান কেটে সাবাড় করার বিষয়ে প্রশ্ন করলে এ কর্মকর্তা বলেন, কৃষি কর্মকর্তারা তো ইঁদুর দমনে কৃষকের ধানের গোড়া ধরে বসে থাকতে পারবেনা, বলে এ প্রতিবেদকে নিউজ না করার জন্য নানা পরামর্শ প্রদান করেন।

  • 30
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে