‘শহরের রোগ’ এখন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও

প্রকাশিত: মে ২২, ২০২৩; সময়: ২:০০ অপরাহ্ণ |
‘শহরের রোগ’ এখন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা; যা অসংখ্য মানুষের অকালমৃত্যু ঘটায়।

একটা সময়ে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ আর স্ট্রোককে ‘বড়লোকের রোগ’ বলে মনে করতেন অনেকে। বর্তমানে আর সে অবস্থা নেই। এখন সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের নীরব মহামারির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণসহ শারীরিক নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে-২০১৮ অনুযায়ী, দেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২১ শতাংশ (নারী ২৪.১%, পুরুষ ১৭.৯%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এই সময়ে পুরুষের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারী ও পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ ও ৪২ শতাশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী ও পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ শতাংশ ও ২৪ শতাংশ।

উচ্চ রক্তচাপ কী? কীভাবে বুঝবেন আপনি উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে?

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, উচ্চ রক্তচাপ হলো একটি নীরব ঘাতক। গতানুগতিক কিছু কারণ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম, কম ঘুম ও অতিরিক্ত ব্যয়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, ঘুম ভালো হলে এবং বিশ্রাম নিলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। যদি কারও রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।

এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, একবার কারও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিলে তা পুরোপুরি কখনোই সারে না, সারাজীবন থাকে। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত কিছু ওষুধপত্র খেতে হবে।

এমন অসংখ্য রোগী আমরা পাই, যারা কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন। তারা মনে করেন, তাদের রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, এখন আর ওষুধ খাওয়ার দরকার কী? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনোক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না।

এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি অঙ্গে মারাত্মক জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃদপিন্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশী দুর্বল হয়ে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর।

রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে। এছাড়া এই রোগের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে এবং চোখের রেটিনাতে রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে।

তরুণ বয়সেই কেন এত আক্রান্ত ও মৃত্যু?

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে হৃদরোগ ও স্ট্রোক। এর মধ্যে হৃদরোগে যত মৃত্যু হয় তার ৪০ শতাংশই হয় অকাল মৃত্যু। আমরা সাধারণত ৭০ বছর বয়সের আগের মৃত্যুকে ধরে নিই অকাল মৃত্যু। এর মধ্যে একটা বিরাট অংশ ৪০ বছরের আগেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, যাদের আমরা তরুণই ধরে থাকি।

এখন এই বয়সে কেন এত আক্রান্ত এবং মৃত্যু হচ্ছে? এর কারণ হলো হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের যে রিচ ফ্যাক্টরগুলো আছে, এর প্রত্যেকটাই আমাদের জনসংখ্যার মধ্যে অনেক বেশি।

তিনি বলেন, আমরা যদি মানুষের খাদ্যাভ্যাসের দিকে তাকাই, প্রথমেই দেখা যায় লবণ বেশি খাওয়া হচ্ছে এবং সে কারণে রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আমরা তেল জাতীয় খাবার অনেক বেশি খাচ্ছি, শাকসবজি আর ফল একেবারেই আমরা খেতে চাই না। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার (ভাত) অনেক বেশি খেতে পছন্দ করি।

তিনি বলেন, কার্বোহাইড্রেট বেশি নিলে স্থূলতা বাড়ে। স্ট্রোক-হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় স্থূলতা। আমরা আমাদের ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি (শারীরিক কর্মকাণ্ড) একেবারেই কমিয়ে দিয়েছি। নানা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিজেদের আমরা ‘টাইম-বোম্ব’ বানিয়ে বসে আছি। যে কারণে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণ হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।

ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী আরও বলেন, আমাদের মধ্যে পরিবর্তনটা একদিনে হয়নি, গত প্রায় ২০ বছরে এই পরিবর্তন এসেছে। আমাদের ইকোনমি ডেভলপমেন্টের সাথে সাথে লাইফস্টাইল পরিবর্তন হয়েছে, রিচ ফ্যাক্টরগুলো পরিবর্তন হয়েছে। আমরা দেখছি কম বয়সে অসংখ্য মানুষ এসব রিচ ফ্যাক্টরগুলোতে মিশে গেছি। এ কারণে আমাদের কম বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।

আশঙ্কাজনকহারে গ্রামেও বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, ছাড়তে হবে যেসব অভ্যাস :

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এনসিডিসি) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের হার বাড়ছে। গত বছর আমরা স্টাডি করে দেখেছি দেশে চারজনে একজনই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। একটা সময় শহরাঞ্চলে এ রোগের আক্রান্তের হার বেশি ছিল, কিন্তু বর্তমানে আশঙ্কাজনকহারে গ্রামেও উচ্চ রক্তচাপের হার বাড়ছে।

তার মতে অল্প বয়সে হৃদরোগ-স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ার কারণ হলো খাওয়া-দাওয়া আর লাইফস্টাইল। লবণ জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড প্রচুর খাওয়া হচ্ছে। এছাড়া ধূমপান, অ্যালকোহলও এর কারণ।

তিনি বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নানা দিক থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। আমাদের পপুলেশন বেইজড হেপাটাইটিস কন্ট্রোলের মতো একটা ইনিশিয়েটিভ আমাদের আছে।

যারাই হাসপাতালে আসছে তাদের বিনা পয়সায় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। আমরা ২৯৯টি উপজেলায় এনসিডি কর্নার স্থাপন করছি যেন মানুষ এগুলোতে আসতে পারে। বাকিগুলোও আমরা ধীরে ধীরে করে ফেলতে চাচ্ছি। এই কাজগুলো আমরা করছি যেন জটিলতা কম হয়।

২০ বছর পর একটা পরিবর্তন হয়তো আসবে :

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, উচ্চরক্তচাপের কথা এলেই লাইফস্টাইল পরিবর্তনের কথা বলা হয়। কিন্তু এই লাইফস্টাইল পরিবর্তনটা কি আজকে বলে দিলে কালকে হবে? ছোটবেলা থেকে যারা অভ্যাস করেছে লবণ খাওয়া, তারা কি লবণ খাওয়া ছেড়ে দেবে? এখন যদি আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করতে পারি তাহলে হয়তো ২০ বছর পর একটা পরিবর্তন দেখতে পারব।

কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের কাছে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া যায় কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে তো কোনো চিকিৎসক নেই। তাহলে সেখানে ডায়াগনোসিস করবে কে? ওখানে ব্লাড প্রেসার মেশিন ও সুগার টেস্ট মেশিন দেওয়া আছে।

আমরা তাদের বলেছি উচ্চ রক্তচাপের কোনো রোগী এলে তাকে যেন স্ক্রিনিং করা হয়। এরপর যদি বেশি ইমারজেন্সি মনে হয় তাহলে যেন এনসিডিসি কর্নারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার আছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। এছাড়া আটটি বিভাগে আটটি বিশেষায়িত ক্যান্সার-হৃদরোগ হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে, রেডি হয়ে গেলে বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা এসে ঢাকায় ভিড় জামাবে না।

প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ১২৮ কোটি মানুষ (৩০-৭৯ বছর) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, যার দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে