ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে ‘হার্ডলাইনে’ শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল

প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৩; সময়: ২:২৫ অপরাহ্ণ |
ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে ‘হার্ডলাইনে’ শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল

পদ্মাটাইমস ডেস্ক: হঠাৎ করেই দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। সরকারে থেকেও বিরোধী শিবিরের নেতার মতো সরকারের ভেতরগত অসংগতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের নানা চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরছেন। তার বক্তব্যে প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-কষ্টও উঠে এসেছে। শুধু সভা-সেমিনার নয়, এসব বিষয়ে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন গণমাধ্যমেও। সেখানে তার কথাবার্তায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিজ মন্ত্রণালয়ে একঘরে হওয়ার তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে কেন হঠাৎ তিনি সরব হলেন? এটা কি কোনো হতাশা থেকে, না ভিন্ন কোনো কারণে? যে উদ্দেশ্যেই তিনি নতুন ভূমিকায় নামেন না কেন, তার বর্তমান অবস্থান সাধারণ মানুষ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। সর্বত্র বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

অবশ্য বিষয়টিকে মূলত শিল্পমন্ত্রী, শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও শিল্প সচিবের ক্ষমতার ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশের অংশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, অনেকটা ক্ষোভ আর হতাশা থেকে জনসমক্ষে এভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী। তার অভিযোগ অমূলক নয়, এটি বাস্তবতারই প্রতিফলন। যা সাধারণ মানুষ বলতে চায়। যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশও পেয়েছে। এখন সরকারের ভেতর থেকেও এসব উচ্চারণ। অবশ্য শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শিল্প প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য কিংবা তার অবস্থান দেখে মনে হয়েছে এটা মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের ক্ষমতা প্রয়োগের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। তার বক্তব্যে এমনও কথা আছে, মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তারা মন্ত্রণালয় বা দপ্তর/অধিদপ্তরে কাউকে নিয়োগ দিতে পারছেন না। যদিও এটি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব না। মূলত সে সুযোগটা পাচ্ছেন না, এটি একটি ক্ষোভের কারণ হতে পারে। তার ধারণা, তার যে কার্যক্ষমতা, সেগুলো তিনি ব্যবহার করতে পারছেন না। অর্থাৎ মন্ত্রী ও সচিব তাকে সেটি করতে দিচ্ছেন না।

যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি দাবি করেছেন, মন্ত্রণালয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সব চলছে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে। ব্যক্তিগতভাবে কারও ভিন্ন মত থাকতেই পারে।

ড. ইফতেখার দাবি করেন, যে প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী কথাগুলো বলছেন, সেগুলো কিন্তু বাস্তবতারই প্রতিফলন। সরকার বা ক্ষমতার প্রশ্নে মানুষের যে ধারণা, বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে যেসব অনিয়মের তথ্য প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলোই এখন সরকারের লোকজনই বলছেন। এর মানে হচ্ছে, সরকারের ভেতরে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার চলে আসছে, সেগুলো স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। আবার এটি বলার কারণে বা প্রকাশের কারণে কাউকে ভিকটিমাইজড করাও সমীচীন হবে না। বরং সরকার এবং রাজনৈতিক দল উভয়েরই উচিত দায়িত্ব নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তার প্রতিকারের চেষ্টা করা।

ভিন্ন ধারার বক্তব্য নিয়ে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার প্রথম আলোচনায় উঠে আসেন গত ১১ মে রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে। ওই সময় তিনি অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থা তথা সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি ও বাজার এ দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে। এই সিন্ডিকেট ধরতে না পারলে এবং ভাঙতে না পারলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকা উচিত না।

দেশে যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে যে লুটপাট হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে—এগুলো সাংবাদিকদের আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে, এগুলো আরও ফোকাস করতে হবে।’ তিনি বলেন, অবাক লাগে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে লাখ লাখ বেকার। অথচ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ মওকুফ করা হয় না। কাদের ঋণ মওকুফ করা হচ্ছে? যারা ব্যাংক থেকে লাখো কোটি টাকা নিয়ে খেলাপি হয়েছে, তাদেরটাই বারবার মওকুফ করা হচ্ছে। তারা মওকুফ পেয়ে আবার ঋণ নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আজকে আমরা দেখছি যে ব্যক্তি লুটপাট করে বড়লোক হচ্ছে, তাকে আরও সুযোগ দিচ্ছি। ফলে কিছু ব্যক্তির কাছে ব্যাংক থেকে শুরু করে সারা অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙতে হবে।

এভাবে প্রতিমন্ত্রী সরকারের মন্ত্রীদের ভেতরে সিন্ডিকেট, শেয়ারবাজারে কারসাজি, একটি ওষুধ কোম্পানি শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় না রেখে ব্যক্তির স্বার্থে সেটি ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়ার বিষয়েও চরম সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন।

বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেসব বিষয় শিল্প প্রতিমন্ত্রী আলোচনায় তুলে আনছেন, সরকারের উচিত হবে সেগুলো আমলে নেওয়া এবং তদন্ত করে দেখা। এগুলো মিথ্যা হলে তাকেই (প্রতিমন্ত্রী) জবাবদিহি করতে হবে। আংশিকভাবেও সত্য হলে সরকার তার প্রতিকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই জনগণ খুশি হবে। জনগণ দেখতে চায় অভিযোগগুলো অন্তত আমলে নেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করে সত্যতা পেলে রাজনৈতিকভাবে সরকার এগিয়ে থাকবে। সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সরকার এখন পর্যন্ত বিষয়টি আমলে নিয়ে সেরকম কিছু করেনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট এগুলো ব্যাপক। অনেক রকম অসংগতি আছে। এগুলো তো হচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই। যারা অস্বীকার করবে, তারা তো সত্যকেই আড়াল করবে। কিন্তু এ ঘটনায় যেটা অস্বাভাবিক, সেটা হলো—কেন প্রতিমন্ত্রী এসব কথাবার্তা কেবিনেট মিটিং বা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন না। দলীয় ফোরামে তোলেন না। প্রধানমন্ত্রীকে জানান না। যদি জানিয়ে থাকেন, প্রতিকার না হয়, তাহলে উনি (শিল্প প্রতিমন্ত্রী) কেন আছেন সরকারে। পদত্যাগ করেন না কেন? এখন যেহেতু সরকারের ভেতরগত নানা সমস্যার কথা পাবলিকলি আলোচনা হচ্ছে। এগুলোর একটা বিহিত হওয়া দরকার। তদন্ত হওয়া দরকার। ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে