ভোজ্যতেলে দুঃসংবাদ, সহজে মিলছে না চিনি

প্রকাশিত: মে ৪, ২০২৩; সময়: ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ |
ভোজ্যতেলে দুঃসংবাদ, সহজে মিলছে না চিনি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : চিনির দাম এমন লাফিয়ে বাড়ছে, ক্রেতার কাছে এখন তা তেতোই ঠেকছে। কমার কোনো লক্ষণ নেই; স্রোত উল্টো দর বাড়ার দিকেই। এ খবরে বাজারের প্যাকেটজাত চিনি কয়েক দিন ধরেই হাওয়া। গলির মুদি দোকান থেকে বড় বাজার কিংবা সুপারশপ– কোথাও মিলছে না চিনি।

পাঁচ-ছয় দোকান ঘুরে খোলা চিনির দেখা পাওয়া গেলেও দাম শুনে অনেক ক্রেতার চোখ উঠছে কপালে। অভিযোগ রয়েছে, বাজারের অস্থিরতার সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী চিনি মজুত করে রেখেছে। ফলে বাজারে বেশ সংকট চলছে চিনির।

এর মধ্যেই ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ হয়ে ধেয়ে আসছে ভোজ্যতেলের দুঃসংবাদ। আবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর সব আয়োজন চূড়ান্ত। এখন শুধু বাড়তি দাম কার্যকরের অপেক্ষা। তার আগেই বাজারে বেড়ে গেছে তেলের দর। ভোজ্যতেলে মূসক (ভ্যাট) ছাড়ের সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় এর দাম বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ পটভূমিতে গতকাল বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তেল ও চিনি ব্যবসায়ীরা।

চিনির বাজার টালমাটাল
কয়েক মাস ধরে চিনির বাজারে এক ধরনের টালমাটাল পরিস্থিতি চলছে। সরকার খোলা চিনি ১০৪ ও প্যাকেটজাত ১০৯ টাকা নির্ধারণ করলেও কোথাও এ দরে কেনা যাচ্ছে না। প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও প্যাকেটজাত চিনি বাজারে একেবারে নেই।

এদিকে গতকাল রাজধানীর মালিবাগ, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি এলাকায় খোলা চিনি পাওয়া গেলেও ভোক্তাকে কিনতে হয়েছে কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা দরে।

সম্প্রতি বিশ্ববাজারে বাড়ার কারণে দেশে দাম বেড়েছে বলে জানান চিনি পরিশোধনকারী মিল মালিকরা। এ অজুহাতে এখন দেশেও চিনির দাম বাড়ানোর দাবি তুলেছেন মিলাররা। তাঁদের দাবি, বিশ্ববাজারে চিনির দাম ব্যাপক হারে বাড়ার কারণে চিনি আমদানি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তাঁরা। গত মঙ্গলবার চিনি আমদানির সিদ্ধান্ত চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার পর গতকাল চিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন।

এদিকে, টিসিবির উদ্যোগে তুরস্ক থেকে প্রতি কেজি প্রায় ৮৩ টাকা দরে সাড়ে ১২ হাজার টন চিনি আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ চিনি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়।

বৈঠকে যেসব পর্যালোচনা
ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ছাড় সুবিধার সময়সীমা শেষ হওয়া এবং বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়ার কারণে নিত্যপণ্য দুটির দাম সমন্বয় করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাড়তে পারে পণ্য দুটির দাম। প্রস্তাবিত দাম নির্ধারণ করে তা পাঠানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তেল ও চিনিতে বিদ্যমান শুল্ক ও ভ্যাট এবং আন্তর্জাতিক দামের বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। এর পর উভয় পক্ষ কাছাকাছি দাম নির্ধারণে সম্মত হয়। এ ব্যাপারে কমিশনের সদস্য শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ডলার সংকটসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য ওঠানামা করছে। এর সঙ্গে দেশে দাম সমন্বয় করতে হয়। দাম নির্ধারণের ব্যাপারে সেসব বিষয় মাথায় রেখে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁরা যৌক্তিক দাম সমন্বয়ের ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন।

ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের পক্ষে টি কে গ্রুপের পরিচালক সফিউল আথহার তাসলিম বলেন, সরকারের দেওয়া ভ্যাট ছাড়ের সুবিধার সময়সীমা ৩০ এপ্রিল শেষ হয়ে গেছে। ওই দিনই ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করার জন্য ট্যারিফ কমিশনের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ, ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা না থাকায় প্রতিদিনই বিক্রয় করা তেলের ওপর কোম্পানিগুলোকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছে। যেহেতু ভ্যাট ছাড়ের সুবিধার সময়সীমা বাড়েনি, তাই নতুন দাম নির্ধারণের আবেদন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে ১৫ শতাংশ হারে প্রতি ট্রাক (সাড়ে পাঁচ হাজার কেজি) তেলের জন্য প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা সরকারকে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম অনেকটাই কমতির দিকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ১ হাজার ৩০ ডলার, যা ফেব্রুয়ারিতেও ছিল ১ হাজার ২৪৩ ডলার। তবে বিশ্ববাজারে দাম কমার এ সুবিধা পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

এ ব্যাপারে সফিউল আথহার বলেন, ট্যারিফ কমিশন বিশ্ববাজার ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। ভ্যাট সুবিধা না থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে তেলের দাম সমন্বয় করতে হবে। তবে দাম সমন্বয় না হলে বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের এক প্রতিনিধি।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই নতুন দামে পণ্য দুটি বিক্রি হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে অংশ নেওয়া তেল পরিশোধনকারী কোম্পানির এক প্রতিনিধি সমকালকে বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার ২০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশন ১৯৮ টাকা করতে চায়। এতে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল রাজি হয়নি। এর মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে বলে ধারণা দেন তিনি। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত প্রতি লিটার তেলের দাম ১৮৭ টাকা। তবে পাঁচ লিটারের দাম, খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দর কত প্রস্তাব করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি।

জানা গেছে, চিনির দাম খুব বেশি বাড়ার আশঙ্কা নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে অংশ নেওয়া এক প্রতিনিধি জানান, চিনির কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বাড়ানো হতে পারে। এমন সিদ্ধান্তই হয়েছে। যদিও এর চেয়ে অনেক বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।

বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেক প্রতিনিধি সমকালকে বলেন, চিনির কেজিতে ২৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। কমিশন কাছাকাছি দামে সম্মত হবে বলে জানিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতি কেজি চিনির দাম শূন্য দশমিক ৫৩ ডলার, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫ ডলার। সে হিসাবে ফেব্রুয়ারির চেয়ে দাম বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮ ডলার। আর গত বছর গড়ে প্রতি কেজির দাম ছিল শূন্য দশমিক ৪১ ডলার।

বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন ভোজ্যতেল ও চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিটি, মেঘনা, এস আলম, বসুন্ধরা, টি কে, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও দেশবন্ধু গ্রুপের প্রতিনিধিরা।

আগেই বেড়ে গেছে তেলের দাম
এদিকে দাম বাড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না এলেও পাাইকারি বাজারে এরই মধ্যে দাম বেড়ে গেছে। কারওয়ান বাজারে খোলা সয়াবিন তেল মণে ৮০ থেকে ৯০ টাকা এবং পাম অয়েল মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলের প্রতি কার্টনে (২০ লিটার) বেড়েছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, এরই মধ্যে মিলাররা তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সব ধরনের তেলে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। মঙ্গলবার খোলা সয়াবিন তেলের মণ ৬ হাজার ২৮৫ টাকা, পাম অয়েলের মণ ৪ হাজার ৯৬৫ টাকা এবং পাম সুপার অয়েলের মণ ছিল ৫ হাজার ১৩০ টাকা। একদিন পরই গতকাল সয়াবিনের মণ ৬ হাজার ৩৫০, পাম অয়েলের মণ ৫ হাজার ১৫ এবং পাম সুপার অয়েলের মণ ছিল ৫ হাজার ২০০ টাকায় উঠেছে।

সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল। তখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৬৭ এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৯০৬ টাকা। এ ছাড়া পাম অয়েলের দাম ধরা হয় ১১৭ টাকা।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে