বাংলাদেশ কখনো ঋণের ফাঁদে পড়েনি: প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: মে ২, ২০২৩; সময়: ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ |
বাংলাদেশ কখনো ঋণের ফাঁদে পড়েনি: প্রধানমন্ত্রী

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বাংলাদেশ কখনও ঋণ খেলাপি হয়নি এবং ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েনি মন্তব্য করে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের লক্ষ্যে ডিজিটাল ও ভৌত অবকাঠামোতে বিশ্ব ব্যাংকসহ বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, “বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সুযোগ এবং খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয় এবং বাংলাদেশ কখনোই ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি বা তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েনি।”

বাসস জানায়, বাংলাদেশ ও বিশ্ব ব্যাংকের অংশীদারত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সোমবার ওয়াশিংটনে এ সংস্থার সদর দপ্তরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ে এ কথা বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, তার সরকার বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আরো বেশি অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে চায়।

“আমরা এখন আমাদের অংশীদারত্বের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই। বিশ্ব ব্যাংককে অবশ্যই দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়নে অর্থায়নের মূল লক্ষ্যের বিষয়ে মনোযোগী থাকতে হবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক সক্রিয়ভাবে আমাদের ডিজিটাল রূপান্তরে সম্পৃক্ত রয়েছে। আমাদের সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার মাধ্যমে আমাদের জনগণের কাছে তার কথা রেখেছে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হওয়ার পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।”

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ডিজিটাল ও ভৌত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের মত উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “আমরা বাণিজ্য বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাই।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংক বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৫৩টি প্রকল্পে যুক্ত এবং এই অর্থ এ পর্যন্ত ব্যাংকের দেওয়া ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ও অনুদানের অংশ।

“মানব সম্পদ উন্নয়নে আমাদের দক্ষতা অবকাঠামোর মেগা-প্রকল্পে আমাদের বিনিয়োগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজস্ব আর্থিক ও কারিগরি সংস্থানে ৬.১ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ আমাদের অর্থনৈতিক পরিপক্কতারই লক্ষণ।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা, বিনামূল্যে ও সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, বিদ্যুৎ সুবিধা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।

“আমরা সার্বজনীন স্বাস্থ সেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, শিশু কল্যাণ, দক্ষতা বৃদ্ধি, নগর উন্নয়ন, টেকসই শিল্পায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের সুযোগ দেওয়ার জন্য বিশ্ব ব্যাংককে অর্থায়ন বাড়াতে হবে।

আসছে সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের এসডিজি সম্মেলনে বিশ্ব ব্যাংক এ বিষয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরের শিহাতা সম্মেলন কক্ষে এই মত বিনিময় অনুষ্ঠানের পর ইস্ট ডাইনিং রুমে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, এমডি এবং ভাইস প্রেসিডেন্টদের সাথে প্লেনারি সেশন এবং মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী।

পরে তিনি বিশ্ব ব্যাংকের প্রেস্টন অডিটোরিয়ামে ‘বিশ্ব ব্যাংক-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের ৫০ বছর বিষয়ে প্রতিফলন’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন।

প্রধানমন্ত্রী সকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরে পৌঁছালে ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক এবং আঞ্চলিক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজার।

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের সঙ্গে যৌথভাবে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন এবং প্রদর্শনীর কিছু অংশ ঘুরে দেখেন।

বিশ্ব ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পরমেশ্বরন আইয়ার, পরিচালক জুনাইদ আহমেদ কামাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনা বিয়েরদে, বিকল্প নির্বাহী পরিচালক আহমেদ কায়কাউস এবং পরিচালকরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেখানে একটি নৃত্য পরিবেশনাও উপভোগ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা ও জ্ঞান অর্জনে বিশ্ব ব্যাংককে আরও বিনিয়োগ করতে হবে।

“বিশ্ব ব্যাংক জলবায়ু অর্থায়নের ওপর জোর দিচ্ছে, এটা উৎসাহব্যাঞ্জক। বাংলাদেশের মত জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা একটি দেশের জন্য প্রশমন ও অভিযোজন উভয় ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত অর্থায়ন প্রয়োজন।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০০৯ সাল থেকে নিজস্ব জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিলের মাধ্যমে ৮০০ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে।

“মূল খাতগুলোতে আমাদের পরিবেশবান্ধব পরিবর্তনের ধারা এগিয়ে নিতে আমরা মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেছি। শুধুমাত্র অভিযোজনের জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের ২৩০ বিলিয়ন ডলার লাগবে। জুন মাসে প্যারিসে জলবায়ু অর্থায়ন বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্ব ব্যাংক এ বিষয়ে আমাদের অর্থবহ আশ্বাস দেওয়ার একটি সুযোগ পাবে।”

বিশ্ব ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরদের সঙ্গে এই বৈঠকে অংশ নিতে পরায় সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “চলতি বছর আমরা ভূ-অর্থনীতিতে বড় কিছু পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি। উত্তরণের পর্যায়ে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব ব্যাপক। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ব ব্যাংকও ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগরের কাছে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ। ইন্দো-প্যাসিফিকের কেন্দ্রস্থলে এর অবস্থান।

“আমরা এখন ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপিসহ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং একটি উদীয়মান প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। তিনটি মানদণ্ডেই যোগ্যতা অর্জন করে আমরা জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে (উন্নয়নশীল দেশে) উত্তরণ লাভ করেছি।

“২০২২ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ১৮.৭%-এ নেমে এসেছে, চরম দারিদ্র্যের দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৫.৬%-এ নেমে এসেছে। কোভিড-১৯ মহামারী, ইউরোপে যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকটের কারণে সৃষ্ট বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এই সব সাফল্য এসেছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল সহিষ্ণুতা। আমরা গণহত্যার পর আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং ১৯৭১ সালে ধ্বংসের মুখে থাকা একটি অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম।

“আমাদের উন্নয়ন যাত্রা মসৃণ ছিল না। বাংলাদেশ বারবার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল, জঙ্গি হুমকি এবং মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। গত দেড় দশকে জাতি অবশেষে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।”

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা ১২ লাখ রোহিঙ্গার জন্য বিশ্ব ব্যাংক অনুদান সহায়তা বাড়িয়েছে। তাদের দীর্ঘ উপস্থিতি আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ দেখিয়েছে যে, তারা প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের তরুণ প্রজন্ম সঠিক রাজনৈতিক পরিবেশে আমাদের জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদাররা এই অগ্রযাত্রার ইতিবাচক দিকগুলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে এবং ভবিষ্যতে একটি প্রতিশ্রুতিশীল উন্নয়ন যাত্রায় বাংলাদেশের সঙ্গী হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন সরকারপ্রধান।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে