রোজায় ক্রেতার হাঁসফাঁস সংসারের ফর্দে কাটছাঁট

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৩; সময়: ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ |
রোজায় ক্রেতার হাঁসফাঁস সংসারের ফর্দে কাটছাঁট

পদ্মাটাইমস ডেস্ক :  রোজা শুরুর আগমুহূর্তে নিত্যপণ্যের বাজারে রীতিমতো আগুন লেগেছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সবজিসহ কয়েকটি পণ্য চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু পণ্যের দাম কারণ ছাড়াই এক লাফে দ্বিগুণ হয়েছে। আবার কিছু পণ্য কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির জন্য আমদানি বন্ধকে ঢাল বানাচ্ছেন, দাঁড় করাচ্ছেন নানা যুক্তি।

তবে তেতে থাকা নিত্যপণ্যের আরেক দফা বৃদ্ধিতে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। তাঁদের কেউ কেউ নির্দিষ্ট টাকায় বাজার করতে গিয়ে গৃহিণীর দেওয়া ফর্দে করছেন কাটছাঁট। এতে খুচরা পর্যায়ে অন্যান্য রমজান শুরুর আগের তুলনায় এবার প্রায় ২০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

ভোক্তা অধিকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি নির্ভরতা বলা হলেও রমজান উপলক্ষে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও অস্বাভাবিক বেড়েছে। দাম বাড়ানোর অপকৌশল ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতোই অতি মুনাফার লোভে নিয়েছেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে রোজার সদাই কিনতে আসা কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুস সালাম বাবলা  বলেন, গতবার যে খেজুরের কার্টন (৫ কেজি) ২ হাজার ৮০০ টাকা ছিল, এবার নিতে হচ্ছে ৪ হাজারে। শুধু খেজুরেই তো ১ হাজার ২০০ টাকা বেশি লাগছে। বাকিগুলোর কথা নাই বা বললাম। পেনশন তো বাড়েনি, বাড়তি খরচ মিটবে কীভাবে?

রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজার থেকে ২৫০ টাকা দরে দুই কেজি তেলাপিয়া কিনে ক্ষোভে ফুঁসছেন সেলিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ব্রয়লার ২৮০ টাকা হয়েছে। কমের আশায় বাজারে এসে তেলাপিয়া মাছও কিনতে হচ্ছে আড়াইশ টাকা কেজি। সব মাছেরই দাম বেশি। এবার রোজা ডাল-ভাত খেয়ে পার করতে হবে।’

রাজধানীর আফতাবনগর থেকে কারওয়ান বাজারে সদাই করতে আসা আবু বকর বলেন, ‘দুই পয়সা কম পাব বলে এখানে এসেছি। কিন্তু যে দাম দেখছি, কম টাকায় কিছু খাওয়ার আর সুযোগ নেই। বছরখানেক আগেও ৫ হাজার টাকায় যে পরিমাণ বাজার কিনতে পারতাম, এখন তা ৮-১০ হাজারেও মিলছে না। বাধ্য হয়ে অনেক কিছুতে ছাড় দিতে হচ্ছে।’

বাবলা, সেলিনা ও আবু বকরের মতো ‘দামের বিপদ’ সঙ্গী করেই কমবেশি সবাই বাজারে আসছেন। কী কিনবেন, তার চেয়ে কোনটি কিনবেন না– তা নিয়েই বেশি ভাবছেন তাঁরা। হিসাবি হয়ে ওঠা ক্রেতাদের বাজারের তালিকা ছোট হওয়ায় বিক্রি কমেছে খুচরা ব্যবসায়ীদের। গতবার রোজা শুরুর আগের তুলনায় এ বছর প্রায় ২০ শতাংশ বিক্রি কমেছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের ভাষ্য, এক বছর ধরে ধাপে ধাপে কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়লেও আয় স্থির রয়েছে। ফলে একই টাকায় এবার পণ্য কেনায় কাটছাঁট করছেন।

কারওয়ান বাজারের তুহিন জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. রায়হান বলেন, ‘রমজানের আগে নাক চুলকানোর সময় থাকত না। এবার বসে মশা মারছি। ক্রেতার ভিড় নেই, ব্যস্ততা কম।’ একই সুরে মহাখালীর মাসুমা স্টোরের বিক্রয়কর্মী আল-আমীন বলেন, ‘বেচা-বিক্রি একদম ঠান্ডা।’ করোনার সময়ের চেয়েও বিক্রি কম বলে জানান কারওয়ান বাজারের শাহ মিরান জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. মামুন। তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের কাছে টাকা নেই। করোনার সময়ও এমন করুণ অবস্থা দেখিনি। গত রোজার তুলনায় বেচাকেনা অন্তত ২০ শতাংশ কমে গেছে।’

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কেজিতে চিনির দাম ৫ টাকা কমতে পারে বলে জানান। তবে বাজারে তার ছিটেফোঁটাও নেই। শুল্ক কমানোর পরও আগের মতো ১১৫ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও সপ্তাহ দুয়েক আগে ছোলার দাম বাড়লেও এখন কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় এক কেজি ছোলা কিনে এখানেই একটু স্বস্তির কথা জানিয়েছেন ক্রেতারা। ভোজ্যতেল, চালসহ আগে থেকেই বেড়ে থাকা পণ্যের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।

মুদির চেয়ে ভিড় এখন খেজুরের দোকানে। মাসখানেক আগে বেড়েছিল খেজুরের দাম। রোজা শুরুর আগমুহূর্তে আরেক দফা বেড়েছে ইফতারির অন্যতম উপাদানটির দাম। ব্যবসায়ীরা জানান, নিম্নমানের খেজুর কেজিতে কমবেশি ২০ এবং ভালোমানের খেজুরে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে নিম্নমানের বা বাংলা খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায়। কালো মরিয়ম ১০০ টাকা বেড়ে ৫৫০-৬৫০, আজোয়া ও মরিয়ম ২০০ টাকা বেড়ে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সবজি আগে থেকেই চড়া। তবে রোজায় হঠাৎ করে তেতে গেছে শসা ও শিম। রাজধানীর ছোট বাজারগুলোতে এক দিন আগেও যে শসা ৫০ টাকা ছিল, বুধবার তা ৯০ টাকায় বিক্রি হয়। একইভাবে ৩০ টাকার শিম হয়ে গেছে ৬৫। লেবুর গায়ে হাত দিতেই ভয় পাচ্ছেন ক্রেতারা। মাঝারি আকারের এক হালি লেবু কিনতেও গুনতে হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। এ দেশে রোজায় বেগুনের চাহিদা বেড়ে যায়।

বিশেষ করে ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে লম্বা বেগুনের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। ব্যবসায়ীরাও এরই সুযোগ নিয়েছেন। ৬০ টাকার থেকে লম্বা বেগুন ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও গোল বেগুন মিলছে ৬০-৭০ টাকায়। আগের মতোই করলা ১০০ থেকে ১২০, বরবটি ৮০-১০০, পটোল ও ঢ্যাঁড়শ ৭০-৯০ ও কাঁচামরিচের কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে এসব পণ্যের জোগানে কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। তবে বড় বাজারগুলোতে তুলনামূলক এসব পণ্য ৫-১০ টাকা কমে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

ঢাকার তেজকুনিপাড়ার সবজি বিক্রেতা মো. রুবেল বলেন, দু-তিনটি ছাড়া পাইকারি বাজারে প্রায় সব সবজির দাম বেড়েছে। সামনে খুচরা বাজারে আরও বাড়বে।

এদিকে, বাজারে পেঁয়াজের সংকট না থাকলেও পণ্যটির দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়েছে। দেশি ৩৫-৪০ এবং আমদানি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন-চার দিন আগেও দেশি পেঁয়াজ ২৫-৩৫ এবং আমদানি পেঁয়াজ ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী শাহিন মিয়া জানান, রোজায় পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের নানা পদক্ষেপের পরও ক্রেতার জন্য সুখবর নেই মাছ-মাংসের বাজারে। দেড় মাস ধরে বাড়তে থাকা ব্রয়লার মুরগি এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায়। সোনালি জাতের মুরগির দামও বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৩৬০ টাকা। বেশ কয়েক দিন ডিমের ডজন ১৩০ টাকায় স্থির ছিল। কিন্তু বুধবার তা বিক্রি হয় ১৪০ টাকায়। মাংসের মতোই নিম্নআয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মাছ। গরিবের মাছ বলে পরিচিত তেলাপিয়া-পাঙাশও মিলছে না ২৫০ টাকার নিচে। আর রুই-কাতলার কেজি কিনতে গুনতে হবে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।

এদিকে, রমজান মাসে খাদ্যপণ্যের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। গতকাল শিল্প মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বাজারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ মুহূর্তে ভোক্তাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। বাজারে রমজানের পণ্যের ঘাটতি নেই।’

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই, এ দেশে ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগ খোঁজেন। আর রোজা তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর সময় বলে থাকেন, চাহিদা ও জোগান ঠিক থাকলে দাম বাড়বে না। কিন্তু শসা, পেঁয়াজ, ব্রয়লার মুরগি এসব তো দেশীয় পণ্য। এরপরও অতি মুনাফার লোভে দাম বাড়িয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীরা নানা যুক্তি দাঁড় করালেও এর সত্যতা পাওয়া যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পণ্যের দাম নাগালে রাখতে বাজারে তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি দোকানে ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ রাখা ও মূল্যতালিকা ঝোলানো নিশ্চিত করতে হবে।’

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে