রাজশাহী-৫ আসনে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বের জাঁতাকলে তৃণমূল

প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৩; সময়: ২:৪০ অপরাহ্ণ |
রাজশাহী-৫ আসনে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বের জাঁতাকলে তৃণমূল

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত সংদীয় আসন রাজশাহী-৫। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে এ আসনটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের দখলে থেকেছে। কখনো জাতীয় পার্টি, কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপির দখলে।

এর মধ্যে ৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত এখানে এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের। আর ৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির দখলে ছিলো এ আসনটি। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনটি ফের দখলে আসে আওয়ামী লীগের। দলের মনোনয়নে সাংসদ নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (বর্তমান) কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হলে নৌকার টিকিট বাগিয়ে এমপি হয়ে যান জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মুনসুর রহমান।

এ আসনে এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অন্তত ডজন খানেক নেতা মনোনয়ন পাওয়ার আশায় মাঠে নেমেছেন। এর মধ্যে কেউ রয়েছেন নবীন আবার কেউ প্রবীন। সম্ভাব্য এসব প্রার্থীরা এখন সুযোগ পেলেই এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছে। এলাকার রাস্তা-ঘাট এবং বিভিন্ন বাজারসহ মোড়গুলোতে ছেয়ে দেয়া হয়েছে নেতাদের শুভেচ্ছা ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে।

ফলে বড় দুই দলের নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বে জাঁতাকলে দিশেহারা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দুইবারের সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারা সঙ্গে বর্তমান এমপি ডা. মুনসুর রহমানের দন্দ্ব প্রকাশ্যে। আর বিএনপির দুইবারের সাবেক সাংসদ নাদিম মোস্তফার সঙ্গে বিএনপির প্রবীন নেতা অধ্যাপক নজরুল ইসলামের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের। যা এখনো বিদ্যমান।

আওয়ামী লীগ

বর্তমান এমপি ডা. মুনসুর ছাড়াও এবারো দলের মনোনয়ন চাইবেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারা। তারা দুইজন ছাড়াও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি প্রয়াত তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুকের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য বদরুল ইসলাম তাপস।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এমপি মুনসুর ও সাবেক এমপি দারার অবস্থান মাঠ পর্যায়ে শক্তিশালী। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সময় পেলেই ছুটে যাচ্ছেন এলাকায়। নির্বাচন কেন্দ্রীক নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি। তবে তৃণমূলের সমর্থন আদায় করে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যানার পোস্টার সাটিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন মাসুদ ও তাপস।

আহসানুল হক মাসুদ বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করে আসছি। এখন পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষও আমার পাশে আছে। এই অবস্থায় দল আমাকে মনোয়ন দিলে আমি নির্বাচনে জয়ী হব বলে বিশ্বাস করি।’

সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে অনেক নেতা আছে। সবাই যে যার মতো করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে নির্বাচনের সময় আসলে অনেকেই পরিচিত হওয়ার জন্য মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে থাকে। তবে যাদের দলে অবস্থান নাই, তারাই বিভেদ সৃষ্টি করছে’ বলে দাবি করেন তিনি।

সাংসদ দারা আরও বলেন, ‘আমি সব সময় মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করে গেছি। সাধারণ মানুষ এবং দলের তৃণমূলের নেতার্কীরাই আমার প্রাণশক্তি। এদের নিয়েই আমি রাজনীতি করি। আমার বাবাও ছিলেন পুঠিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কাজেই আমাদের নাড়ীতেই রয়েছে রাজনীতি। আমরা জনগণের মূল্যায়ন করি। তাদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্যায়নই বড় কথা। ফলে শুধু নির্বাচন কেন্দ্রীক নয়, আমি কাজ করে যাচ্ছি দলের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য। এটি পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষ জানে।’

প্রফেসর ডাঃ মো. মনসুর রহমান বলেন, আমার সংসদীয় এলাকার দুটি উপজেলার মানুষ বিগত যেকোনো সময়ের চাইতে সুখে শান্তিতে আছেন। এ আসনে রাজনৈতিক কোন কলোহ-বিবাদ নাই বললেই চলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদে মডেল মসজিদ নির্মাণ, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ, রাস্তাঘাট সহ এই এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ও এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে আগামীতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে আমি শতভাগ আশাবাদী। এছাড়া এই আসনে আমাকে মনোনয়ন দেয়া হলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুণরায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আসনটি উপহার দিতে সক্ষম হবো।

বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে এবার বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির অন্তত হাফ ডজন নেতা। বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেবে কি না তা এখনো চুড়ান্ত না হলেও হাই কমান্ডের নির্দেশে ভোটের মাঠে নেমেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই। বিশেষ করে নিজের পক্ষে সমর্থন পেতে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে। তবে এবার ক্লিন ইমেজের নেতা চান বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা। ২০০৭ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এলাকা ছাড়েন তিনি। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নাদিমের স্থলে মনোনয়ন দেওয়া হয় পুঠিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম মন্ডলকে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে নজরুল ইসলাম পরাজিত হন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নাদিম মোস্তফা ও নজরুল ইসলাম মন্ডল দলের মনোনয়ন চাইবেন।

তারা দুইজন ছাড়াও রাজশাহী-৫ আসনে এবার মনোনয়ন চাইবেন, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক আবু বকর সিদ্দিক, দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি গোলাম সাকলাইন, বিএনপির নেত্রী মাহবুবা হাবিবা, বিএনপি নেতা ইসফা খায়রুল হক শিমুল ও দুর্গাপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহেদ মোল্লার ছেলে সিরাজুল কবির সনু।

আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে তিনি মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সে সময় দলের হাই কমান্ড পরবর্তি নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার আশ^াস দিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকবে বলেন। তখন থেকে আমি পুঠিয়া-দুর্গাপুরের রাজনীতির মাঠে রয়েছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীদের এক জায়গার করার চেষ্টা করেছি। এতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি বলে জানান তিনি।

গোলাম সাকলায়েন বলেন, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। ছাত্র অবস্থায় থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি পেশায় একজন ব্যবসায়ী এবং কৃষক। তাই সাধারণ মানুষ নিয়েই আমার পথচলা। আমি দেশের জন্য, সমাজের জন্য রাজনীতি করি। দলের নেতাকর্মীরাও আমাকে কাছে টেনে নেন খুব সহজেই। এ কারণে তাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে ভাল করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন বিএনপির এই নেতা।

নজরুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, বিগত ২০০৮ সালে যখন সবাই পলাতক ছিল, তখন আমি নেতাকর্মীদের পাশে থেকে নির্বাচন করেছি। তবে সামান্য ভোটে পরাজিত হয়েছিলাম। সেই থেকে জনগণের সঙ্গেই আছি। এবারো দল আমার প্রতি আস্থা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা বলেন, আমি পুঠিয়া-দুর্গাপুরবাসীর জন্য যা করে দিয়েছে-তা আগামী ১০০ বছরেই অন্য কোনো এমপি করতে পারবেন না। কারণ আমি রাজনীতি করেছি সাধারণ মানুষকে নিয়ে। সাধারণ মানুষই হচ্ছে আমার শক্তি। তাদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্যায়ন করেছি সবসময়ের জন্য। আগামীতেও তাদের জন্যই রাজনীতি করতে চাই। এই অবস্থায় দল আমাকেই মনোনয়ন দেব এবং নির্বাচিত হয়ে পুঠিয়া-দুর্গাপুরের অসামাপ্ত কাজগুলো করতে চাই।

জাতীয় পার্টি

আগামী নির্বাচনে দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে চান জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সাবেক এমপি অধ্যাপক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হোসাইন মোহাম্মাদ এরশাদের আমলে উপজেলা গঠনসহ উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশী উন্নয়ন হয়েছে। সেটি মানুষের মনে রয়েছে। ফলে জাতীয় পার্টিকে মানুষ ভুলেনি। তারা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছে। তাই আগামী নির্বাচনে নাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ভোট করতে চাই।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে