বঙ্গবন্ধু কলেজে ১৭ শিক্ষক-কর্মচারী অবৈধ নিয়োগ ধরে ফেলায় হাজিরা খাতা গায়েব

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৩; সময়: ৬:৩৩ অপরাহ্ণ |
বঙ্গবন্ধু কলেজে ১৭ শিক্ষক-কর্মচারী অবৈধ নিয়োগ ধরে ফেলায় হাজিরা খাতা গায়েব

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী মহানগরীতে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু কলেজে অবৈধ উপায়ে হঠাৎ করে অন্তত ১২ জন শিক্ষক ও পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতীয়করণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি দল কলেজটি পরিদর্শনে আসলে বিষয়টি সামনে আসে। তবে কলেজের অধ্যক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, কলেজের শিক্ষকদের হাজিরা খাতা হারিয়ে গেছে। এমনকি তিনি কলেজটিতে ঠিক কতজন শিক্ষক ও কর্মচারী আছেন সেই তথ্যটকুও দিতে পারেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের একাধিক শিক্ষক জানান, গত বছরের ১২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু কলেজ জাতীয়করণ করার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কলেজে সব ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদ হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে শিক্ষা অধিদপ্তর। এদিকে গত ৪ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের একটি অডিট কমিটি কলেজ পরিদর্শনে আসেন। এসময় হঠাৎ করেই শিক্ষক ও কর্মচারীদের (নন-এমপিও) হাজিরা খাতায় অন্তত ১২ জন শিক্ষক ও পাঁচজন কর্মচারীর নতুন নাম লক্ষ্য করেন শিক্ষকেরা।

কলেজে নতুন ১৭ জন শিক্ষাক ও কর্মচারী নিয়োগে প্রায় কোটি টাকার অবৈধ ভাবে নিয়োগ বানিজ্য হয়েছে। নতুন এসব শিক্ষক-কর্মচারীর কাছে থেকে প্রতি জনের কাছে থেকে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে বানিজ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।

বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন শিক্ষক আপত্তি তোলেন। এ সময় অধ্যক্ষপন্থি শিক্ষকদের সঙ্গে আপত্তি তোলা শিক্ষকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে করে কলেজটির অধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামানসহ উভয়পক্ষের কয়েকজন শিক্ষক আহত হন।

বঙ্গবন্ধু কলেজ জাতীয়করণের জন্য সরকারি নথি যাচাই করে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা অধিদপ্তর রাজশাহী জেলা প্রশাসনকে সংশ্লিষ্ট কলেজটি প্রাথমিকভাবে অডিট করতে নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনা অনুসারে জুলাইয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কলেজটি পরিদর্শন করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদন অনুসারে কলেজটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ হাজার ৯১ জন। এছাড়া কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ১২৮ জন (অধ্যক্ষ ও উপাধক্ষ বাদে)। এদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ২৫ জন, এই শাখায় নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক নেই। স্নাতক পর্যায়ে এমপিভুক্ত শিক্ষক ২৮ জন এবং নন-এমপিওভুক্ত ১৩ জন। স্নাতক সমমানের নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক ৬২ জন, তবে এই শাখায় এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক নেই।

এদিকে গত ৪ মার্চ কলেজটিতে মাউশির অডিট কমিটি পরিদর্শনে আসলে কলেজটির নন-এমপিও শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় অন্তত ১২ জন নতুন শিক্ষকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর নন-এমপিও কর্মচারীদের খাতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় পাঁচ জন নতুন কর্মচারীর নাম। নতুন শিক্ষকদের নামের তালিকার মধ্যে আট জনের নাম ও বিভাগ জানা গেছে।

এরা হলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক আমিনা খাতুন, মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক মো. সোহরাব হোসেন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আইরিন পারভীন, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক জুয়েল আহমেদ, প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো. আব্দুর রাজ্জাক, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. রফিকুল ইসলাম এবং সহকারী গ্রন্থাগারিক সাকিল সরদার।

২০২২ সালের ১১ আগস্ট কলেজটির আগের অধ্যক্ষ মো. নুরুল ইসলাম অবসরে যান। এরপর ১২ আগস্ট থেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপাধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামান। এরপর গত ১১ ডিসেম্বর তিনি কলেজটিতে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে ১২ মে অধ্যক্ষ হিসেবে তার নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে অধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের বা আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য ওয়াহেদুন্নবি অনু বলেন, গভর্নিং বডি শুরু থেকেই কলেজটির অধ্যক্ষকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে বলে আসছে। তবে তিনি তা দিচ্ছেন না। এর মাঝে সম্প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের হাজিরা খাতায় হঠাৎ করে নতুন বেশ কিছু নাম দেখেন শিক্ষকেরা। এনিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে অডিট কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে ৪ মার্চ শুক্রবার শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কলেজের অধ্যক্ষ নিজের খেয়াল খুশিমত যেকোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ও কাজ করছেন।’

কলেজের অধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামান দাবি করেন, তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত কলেজের কোনো কাগজপত্র বুঝিয়ে দেননি আগের অধ্যক্ষ। তবে এক যুগেরও বেশি সময় এই কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকলেও অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান জানেন না, কলেজে কতজন শিক্ষক বা কর্মচারী কর্মরত। তিনি বলেন, ‘গত ৪ মার্চ শিক্ষকদের সাথে সংঘর্ষের পর থেকে কলেজের হাজিরা খাতা হারিয়ে গেছে। হাজিরা খাতা না দেখে নতুন শিক্ষকের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে কি না এর উত্তর তিনি দিতে পারব না।’

এদিকে বঙ্গবন্ধু কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০২২ সালের ১১ আগস্ট আমি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসরে যাই। ওই সময় পর্যন্ত কলেজটিতে নন-এমপিও ও এমপিও সহ মোট ১৩০ জন শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া এমপিওভুক্ত কর্মচারী ছিলেন ১৫ জন। এদের মধ্যে তিন জন তৃতীয় শ্রেণীর এবং বাকিরা সবাই চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী।

তিনি বলেন, কলেজের হাজিরা খাতা হারাবার সুযোগ নাই। হাজিরা খাতা শুরু থেকেই আছে।

কলেজটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি আরিফুল হক কুমার বলেন, শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় নতুন করে শিক্ষকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আমার কিছু জানা নাই। এধরনের নানান কথা নানান জন বলছেন। তবে বাস্তবে আমি এমন কিছু দেখিনি সেখানে।

হাজিরা খাতা হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই খাতা দেখার কাজ সভাপতির না।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে