ভাবনার চেতনায় অমর একুশ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩; সময়: ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
ভাবনার চেতনায় অমর একুশ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : জন্মসূত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো আমরা বাঙালি এবং বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা বাংলা বললেই আমাদের সবার ভাবনাতেই যে ছবিটা ভেসে ওঠে তা হলো একুশের চেতনা।

এক্ষেত্রে আমার জীবনে আমি একটি বিশেষ সুবিধা পেয়েছি এই জন্য যে, আমার জন্মস্থানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায়। যেখানে ছোটবেলা থেকেই আমার সখ্যতা ও সুযোগ তৈরি হয়েছিল শহিদ মিনারের সঙ্গে।

শহিদ মিনার আবাসিক এলাকার যে বাসাটিতে আমি দীর্ঘ ২৫টি বসন্ত কাটিয়েছি সেখানে আর সব স্মৃতির মধ্যে অমলিন এক দৃশ্যপট হলো একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিপট, যা সর্বাধিক সমুজ্জ্বল। রক্তের শিরা উপশিরায় এখনো মিশে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি।

এখনো মনে পড়ে ফেব্রুয়ারি মাস শুরু মানেই আমাদের বসন্ত বন্দনা আর প্রতিদিন পথনাটক দেখতে শহিদ মিনারে ভিড় করা। কৃঞ্চচূড়া গাছের নিচে বসে ফুচকা খেতে খেতে আমরা কতদিন যে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর গান শুনেছি।

প্রতিবারই আমার মনে হতো একুশ যেন সত্যিই আলাদা কিছু যা মানুষকে নতুন করে দেশপ্রেম শেখায়। আর ২০ তারিখ এলেই বিকেল বেলায় চারুকলার শিক্ষার্থীদের বিনা পারিশ্রমিকের পরিশ্রমে ফুটিয়ে তোলা একুশের চিত্র আমাকে নতুন করে ভাষার প্রতি মমতাময়ী হওয়ার প্রেরণা জোগাত। আমি ওদের অক্লান্ত পরিশ্রমের দিকে তাকিয়ে হিংসে করতাম এটা ভেবে যে, কেন আমি এতে অংশগ্রহণ করতে পারছি না?

২০ তারিখের সন্ধ্যার পর থেকে আমার অনুভূতিতে আরো অপেক্ষা যোগ হতো যখন দেখতাম আমাদের পাড়ায় পুলিশের প্রহরা বেড়ে গেছে আর সময় এগিয়ে আসছে ১২টা এক মিনিটের দিকে। কখন আসবে সেই ক্ষণ যখন আমরা সরাসরি দেখতে পাবো শহিদ মিনারে একুশের ফুল দেওয়ার সেই সুন্দর ও দুর্লভ দৃশ্য।

দুর্লভ দৃশ্য বলছি এই কারণে যে, আমরা একই সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় আবার বারান্দা থেকে সরাসরি শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্য দেখতাম। আমার জীবনের সেই রাতগুলো কাটত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির’ গানের সুর ও ছন্দের সঙ্গে। একুশের চেতনা আমাদের জীবনে আমাদেরকে প্রতিবারই মনে করিয়ে দিত কতটা ত্যাগ আর কষ্ট লুকিয়ে আছে এই গানের পেছনে।

ভাবতাম, একটি দেশের মানুষ কতটা মানসিক দিক থেকে শক্তিশালী হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আন্দোলনে চলে যায়! আমার স্কুল জীবনে জহির রায়হানের লেখা একুশের গল্পের সেই তপুর কথা মনে পড়ে যেত যাকে ভাষা আন্দোলনে শহিদ হতে হয়েছিল আর তাকে তার বন্ধুরা খুঁজে পেয়েছিল কঙ্কাল হিসেবে মেডিক্যালে পড়তে গিয়ে।

আমার সমস্ত রক্ত হিম হয়ে যেত যতবার আমি সেই গল্পটার কথা ভাবতাম। একুশ আমাদের জাতীয়তাবোধের চেতনা। আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের আবেগ, আমাদের প্রেরণা।

ছোট ছোট শিশু যখন বাবা-মায়ের হাত ধরে শহিদ মিনারে ফুল দিতে আসে তখন তাদের কোমল হাতগুলো যেন শহিদদের রক্তমাখা শরীরকে স্পর্শ করে আর বুলেটের আঘাতকে ফুলের গন্ধে ভরিয়ে তোলে।

একদিনের জন্য আমরা আমাদের এই চেতনাকে যদি জমিয়ে না রেখে সবসময় পালন করতাম তাহলে শহিদ মিনারে দাঁড়িয়ে থাকাটা অনেক বেশি করে আমাদের কণ্ঠে ধারণ করতে পারতাম।

বাংলা ভাষাকে সঠিক ও সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে আমাদের এখনো যতরকম সমস্যা। সন্তানরা বাসায় ইংরেজি বলে, ভালো বুঝতে পারে—একথা বলায় পিতামাতা যতটা আনন্দ পায় ততটা আনন্দ পায় না বাংলা ভালো জানে একথা বলার মধ্যে! সন্তান ভালো বাংলা বলতে পারে বা বাংলায় লেটার নম্বর পেয়েছে বললে অনেক অভিভাবক উত্তর দেন—বাংলাতে নম্বর তোলা তো কোনো ব্যাপার না, আসল হলো ইংরেজি।

যদিও আমি এখানে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে বিতর্ক করতে আসিনি, তারপরও একটি কথা না বলে পারছি না। বিষয় বাংলা বা ইংরেজি কতটা ভালো জানে তা নয়, মূল জায়গাটা হলো শ্রদ্ধার। কেউ তার মাতৃভাষাকে ভালোভাবে না জানলে, সম্মান না করলে লজ্জাটাও তার, অসম্মানটাও তার।

মাতৃভাষা তো শুধু একটি ভাষা বা কিছু অক্ষরের সমষ্টি নয়, ভাষা হলো মূল্যবোধ, সম্পদ, জাতীয়তাবোধ, চেতনা, মনোভাব, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। আনন্দের মতো আমাদের কান্নার ভাষাও কিন্তু বাংলাই। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা মাতৃভাষার কাছে ঋণী।

কত শব্দ যে আমরা বাংলা থেকে বিলীন করে দিচ্ছি অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে! আমার কাছে তো মনে হয়, পারিবারিক সম্পর্কগুলোর আবেগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভাষার অপপ্রয়োগে। সস্তা কোনো কিছুই বেশিদিন সমাজে টিকতে পারে না। অথচ বিবর্তিত শব্দের জায়গায় বিকৃত শব্দ যেন টিকে যাচ্ছে।

একটি বিষয় আমার উপলব্ধিকে আরও দ্বিগুণ করে যখন মনে হয় আমরা যন্ত্রের সুবিধা যেমন নিচ্ছি একই সঙ্গে যন্ত্রকে জীবন বানিয়ে ফেলছি। আধুনিক প্রযুক্তির দরকার আছে; কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণের সুতোটা নিজের হাতেই রাখা উচিত। ভালোবাসা অদৃশ্য কিন্তু অস্তিত্বহীন নয়।

তাই আবেগ বা ভালোবাসা নষ্ট হয়—এমন কোনো কিছুই জীবনকে সুন্দর ও আনন্দ দেবে—এটি ভাবলে আর যা-ই হোক তাকে বুদ্ধিমান প্রাণী বলার কোনো কারণ আছে বলে তো মনে হয় না। আমাদের সম্পদ আমাদের এই বাংলা ভাষা।

সম্পত্তিকে বিপদে বিক্রয় করা যায় আর সম্পদকে আগলে রাখতে হয়। তা না হলে নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তাই যেতে যেতে বলতে চাই, অমর একুশ, অজেয় একুশ। তোমাতে যাত্রা শুরু, তোমাতেই শেষ।

লেখক : তামান্না তাসকীন- সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে