ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা তৈরিতে গাফিলতি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩; সময়: ১০:২২ পূর্বাহ্ণ |
ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা তৈরিতে গাফিলতি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সরকারের পর সরকার বদলেছে। পেরিয়ে গেছে কয়েক যুগ। কিন্তু আজও তৈরি হয়নি ভাষাসংগ্রামীদের নামের তালিকা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’-এর সেনানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।

তালিকা তৈরির জন্য দায়সারা গোছের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ৬৮ জন ভাষাসংগ্রামীর নামসংবলিত গেজেটও প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু তালিকার কিছু নাম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে কাজটি স্থগিত করা হয়।

পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়। এরপর ১৩টি বছর চলে গেলেও এর অগ্রগতি শূন্য। শুধু তাই নয়, কাদের ভাষাসংগ্রামী বলা হবে অথবা বলা হবে না-এ সংক্রান্ত কোনো ‘নির্ণায়ক’ বা সংজ্ঞা অদ্যাবধি প্রণয়ন হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তদের চরম গাফিলতির কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, ভাষাসংগ্রামীদের একটি বড় অংশ মানুষের মুখে আর বইয়ের ভাষাতেই আছে। রাষ্ট্রের কোনো স্বীকৃতি তাদের মেলেনি।

ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করা এখন প্রায় অসম্ভব-এমন মন্তব্য করেছেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে অবহেলা হয়েছে। সেটা সব আমলেই। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ১৬ খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র সংরক্ষণ, সংকলন বা ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছুই হয়নি। এমনকি বর্তমানে ইচ্ছা থাকলেও আর সেটা করা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের বন্ধুবান্ধব যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই আজ প্রয়াত।

কয়েক বছর ধরে ভাষাসংগ্রাম নিয়ে গবেষণা করছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও লেখক গোলাম কুদ্দুছ। তিনি ইতোমধ্যে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু বইও প্রকাশ করেছেন।

গোলাম কুদ্দুছ যুগান্তরকে বলেন, কে ভাষাসৈনিক আর কে ভাষাসৈনিক নন, তার কোনো ‘নির্ণায়ক’ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন একটি ‘নির্ণায়ক’ আছে। যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন, যারা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লড়াই করেছেন, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যারা সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছেন-তারা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ভাষাসংগ্রামীদের কেনো ‘নির্ণায়ক’ নেই।

হতে পারত যারা ভাষাসংগ্রামের আন্দোলনে মারা গেছেন, যারা গ্রেফতার হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, যারা ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন জেলার কমিটিতে ছিলেন-তারা ‘ভাষাসংগ্রামী’।

এভাবে যদি কিছু নির্ণায়ক নির্ধারণ করা যেত এবং সেই অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত নিরপেক্ষভাবে সংগ্রহ করে তালিকা করা হতো, তাহলে সেটি ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা হিসাবে গণ্য করা যেতেও পারত।

কিন্তু এখন যেহেতু কোনো ‘নির্ণায়ক’ নেই, তাই আর সঠিক তালিকা সম্ভব নয়। একুশে পদকে, ভাষাসংগ্রামের মিছিলে হেঁটেছিলেন-এমন মানুষকেও পদক দেওয়া হয়েছে। এটি কি আদৌ সঠিক প্রক্রিয়া!

তিনি বলেন, ‘ভাষাসংগ্রামীসংক্রান্ত সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এটি স্পষ্ট না করে যদি কোনো তালিকা করা হয়, তাহলে ভাষাসংগ্রামীর নামে একটি বিতর্কিত তালিকা হবে। এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ যুগান্তরকে বলেন, ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা এখন বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা ভাষাসংগ্রামী, যারা মিছিলে অংশ নিয়েছেন তারাও বলেন ভাষাসংগ্রামী। সেদিক থেকে লাখ লাখ মানুষ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

প্রসঙ্গত, ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামীদের তালিকা তৈরির আবেদন জানিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তালিকা তৈরির নির্দেশ দিলে সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা পেশ করেছিল, যেখানে জিল্লুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমানসহ ৬৮ জন ভাষাসংগ্রামীর নাম ছিল।

তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে এমন কিছু নামও ছিল, যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ নয় এবং সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে-এমন অভিযোগে এ তালিকা প্রণয়নের কাজটি স্থগিত করা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল।

সেই প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল শুধু ঢাকায়। কমিটিতে আরও ছিলেন রফিকুল ইসলাম ও মুনতাসীর মামুন। কিন্তু সেই কমিটির মাত্র একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে কাজের পদ্ধতির জটিলতা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়। এরপর থেকে তালিকা প্রণয়নের কাজটি কার্যত বন্ধ রয়েছে এবং বিষয়টি সরকারিভাবে সম্পন্ন করার আদৌ আর কোনো উদ্যোগ নেই বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে