রাজশাহীতে নিজ জমি রেখে অফিসের জন্য অর্পিত সম্পত্তি নিল জেলা আ.লীগ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩; সময়: ৬:০৯ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে নিজ জমি রেখে অফিসের জন্য অর্পিত সম্পত্তি নিল জেলা আ.লীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় করতে আড়াই কোটি টাকা খরচ করে ভবন উঠছে নগরীর সিটিবাইপাশ সিলিন্দা এলাকায়। এর কাজও প্রায় শেষ। কয়দিনের মধ্যেই সেখানে ভবনটি উদ্বোধন করে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে সরগরম হওয়ার কথা ছিল নতুন ওই কার্যালয়টি।

কিন্তু এরমধ্যেই জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় করার জন্য সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা জেলা প্রশাসন থেকে দলের নামে একটি অর্পিত সম্পত্তি বরাদ্দ নিয়েছেন। নতুন ভবনে না গিয়ে দলীয় কার্যালয়ের জন্য সরকারি সম্পত্তি বরাদ্দ নেওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।

আবদুল ওয়াদুদ দারা রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। জেলা আওয়ামী লীগের ভবন করার জন্য ২০১৭ সালেই শহরের সিটিহাট এলাকায় ১০ কাঠা জমি কিনে দেন রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। এই জমিটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এখন সেখানে প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করে সাড়ে চার হাজার স্কয়ার ফুটের একটি ভবনও করে দিচ্ছেন এমপি এনামুল হক।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এমপি এনামুলের দেওয়া জায়গায় দলীয় কার্যালয় নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি নির্মাণ কাজের অগ্রগতিও পরিদর্শন করেন। এরমধ্যেই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলীয় কার্যালয়ের জন্য জায়গা চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের ভিত্তিতে গত রোববার শহরের রাণীবাজার এলাকার একটি অর্পিত সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জায়গাটির পরিমাণ ৮ কাঠা। এরপর এই স্থানটি জেলা আওয়ামী লীগের শাখা কার্যালয় বলে ব্যানার টানানো হয়েছে। এমপি এনামুলের করে দেওয়া নির্মাণাধীন ভবনেও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় বলে ব্যানার টানানো আছে।

গতকাল সকালে রাণীবাজারের ওই অর্পিত সম্পত্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কয়েকটি অনেক পুরনো ঘর আছে। শৌচাগার, রান্নাঘরও আছে। জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল মান্নান কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন। আরিফা খাতুন নামের মাঝবয়সী এক নারী ওই বাড়িতে বাস করতেন। সকালে ঘরে তালা দিয়ে তাকে বের হতে দেখা যায়।

তখন তিনি জানান, থাকার কোন জায়গা নেই বলে তিনি ছেলেকে নিয়ে পাঁচবছর ধরে এখানে থাকতেন আর সেলাইয়ের কাজ করতেন। এক সপ্তাহ ধরে তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। দুদিন ধরে এখানে রান্নাও করতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি ভাড়া নেওয়ার জন্য বাড়ি খুঁজছেন। কিন্তু সামর্থ্যের মধ্যে বাড়ি পাচ্ছেন না। তাকে একটু সময়ও দেওয়া হচ্ছে না। এখন আবার বাড়ি খুঁজতে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান বললেন, শুক্রবার বিকালে এখানে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে এটিই জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করবে। লিজ নেওয়া জমিতে সুযোগ থাকলে তারা এখানে আধুনিক ভবন নির্মাণ করবেন।

আওয়ামী লীগকে জমি বরাদ্দ নিয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শরীফুল হক বলেন, ‘রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য অর্পিত সম্পত্তি যে কোন ব্যক্তি, সংস্থা বা সংগঠনকে লিজ দেওয়া যায়। জেলা আওয়ামী লীগ অফিস করার জন্য জায়গা খুঁজছিল। খুঁজে খুঁজে তাঁরা রাণীবাজারের এই জায়গাটির জন্য আবেদন করেছে। কাকতালীয়ভাবে তাঁরাই লিজ পেয়েছে। এখন প্রতিবছর তাদের লিজের টাকা জমা দিয়ে নবায়ন করতে হবে।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভপতি রন মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। আর সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুল ওয়াদুদ দারা। এই সম্মেলনের আট বছর আগে থেকে শহরের লক্ষ্মীপুরে জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ছিল। নতুন কমিটি জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় করে অলোকার মোড়ে একটি ভাড়া নেওয়া দোকানঘরে। এরমধ্যে সভাপতি মেরাজ উদ্দিন মোল্লা মারা যান। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন অনিল কুমার সরকার। তিনি বাগমারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। স্থানীয় এমপি এনামুলের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল বলে তিনি দলীয় কার্যালয়ের নতুন জায়গা বরাদ্দের আবেদনে সই করেননি। তাকে ছাড়া সাধারণ সম্পাদক একাই আবেদন করেন।

জানতে চাইলে অনিল কুমার সরকার বলেন, ‘এটা সাধারণ সম্পাদক তো একাই আবেদন করতে পারেন। আবেদনে আমি সই করেছি কি না তা মনে নেই।’ জেলা আওয়ামী লীগকে জমিদাতা এমপি এনামুল হক মনে করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের সময় তিনি দলকে জমি কিনে দিয়েছেন বলে নতুন কমিটি সেখানে দলীয় কার্যালয় করছে না।

জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এমপি এনামুল হক বলেন, ‘আমি দলের নামে জমি রেজিস্ট্রি দিয়ে ২০১৭ সালে জেলা আওয়ামী লীগের তখনকার কার্যকরী কমিটির মিটিংয়ে দলিল সাবমিট করেছি। তারা গ্রহণ করেছে। এখন তারা মনে করছে আসাদের সময় জমির রেজিস্ট্রি হয়েছে, এখন সেখানে পার্টি অফিস করব না। এইটা একটা জাস্ট পার্সেনাল জেলাসি থেকে করছে, করুক। তবে হ্যাঁ, সরকারি জায়গায় কোনভাবেই পার্টি অফিস করার সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘এতদিন কেউ করেনি, আমি করে দিয়েছি। ভালই লাগছে। আমি জমি দিয়েছি বলেই তো কেউ জেলাসি করে আরেকটা নিচ্ছে। আগে করলেই তো আমার দেওয়া লাগতো না।’

জেলা আওয়ামী লীগের আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘এমপি এনামুল হক জেলা আওয়ামী লীগকে জায়গা দিয়েছেন। তিনি দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমতি নিয়ে সেখানে ভবনও করে দিচ্ছেন। এখন সেটাকে অবজ্ঞা করে নতুন জায়গায় কার্যালয় করাটা খারাপ। এর মাধ্যমে দলের মধ্যে শুধু বিভাজন তৈরি হবে। এ উদ্দেশ্যেই এটা করা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারা বলেন, ‘কোনভাবেই দলীয় বিভেদ হওয়ার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের নামে যে কেউ সম্পত্তি দান করে দিতেই পারেন। এখন সিটিং আওয়ামী লীগ বসে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাই সিদ্ধান্ত। যে জায়গাটি লিজ নিয়েছি, সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের অফিস হবে।’ সিটিহাটের অফিস কি হবে জানতে চাইলে দারা বলেন, ‘আমি জানি না।’

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে