অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসি নিয়ে উত্তপ্ত রুয়েট

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩; সময়: ৩:১৪ অপরাহ্ণ |
অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসি নিয়ে উত্তপ্ত রুয়েট

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ভাইস চ্যান্সেলর (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেনের নানা অনিয়ম, অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই অতিরিক্ত দায়িত্বের এই ভিসির বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক-ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্যাম্পাসে সংগঠিত করে প্রগতিশীলদের কোণঠাসা করার বিস্তর অভিযোগও উঠেছে। শুধু তাই নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ও আইন ভেঙে অনধিকার চর্চা, ‘যাচ্ছেতাই কর্মকাণ্ড’ করে কয়েক মাসেই পুরো ক্যাম্পাসে ‘অরাজক পরিস্থিতির’ সৃষ্টি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ড. সাজ্জাদ দায়িত্ব পেয়েই পূর্ণাঙ্গ ভিসির সার্বক্ষণিক গাড়ি, ভিসির নির্ধারিত মোবাইল ফোন, দপ্তর ব্যবহার এবং নেমপ্লেটে পূর্ণাঙ্গ ভিসি হিসেবে নাম ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া তিনি পার্সোনাল গার্ড ও অন্যান্য সুবিধাও নিয়েছেন ভিসির মতোই। অথচ বিধি অনুযায়ী অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসির

এমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার নিয়ম নেই। শুধু তাই নয়, রুয়েটের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যানারেও পূর্ণাঙ্গ ভিসির পদবি ব্যবহার করেন তিনি, যাকে অনৈতিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট ডিনের পাশাপাশি রুয়েটের ভিসির (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব পান তিনি। গত ১৬ আগস্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাসা বরাদ্দের নোটিশ করান। বিধি অনুযায়ী প্রফেসর কোয়ার্টার (এ-২/এ বিল্ডিং) অধ্যাপকের (গ্রেড ১ থেকে ৩) নিচের পদের (সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক) কোনো শিক্ষককে বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই; কিন্তু তিনি গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রফেসরস কোয়ার্টার (এ-২/এ বিল্ডিং) বরাদ্দ দেন।

প্রতিক্রিয়াশীলদের সংগঠিত করার চেষ্টা-

অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক-বিষয়টি সবার জানা। ২০১১ সালে ও ২০১৮-১৯ সেশনে বিএনপি-জামায়াতপন্থি (পরিবর্তনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী) প্যানেল থেকে রুয়েটে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন সদস্য পদে ভোট করেন।

এ জন্য দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ক্যাম্পাসে বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শক্তিশালী করছেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। দায়িত্ব পাওয়ার পর রুয়েটের নির্বাহী প্রকৌশলী, জামায়াতপন্থি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠক, রুয়েটে ছাত্রশিবিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সাবেক শিবির নেতা আহসান হাবীব এবং বিএনপিপন্থি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠক কামাল হোসেন ইতিকে অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বানিয়েছেন ডান-বাম হাত। ক্যাম্পাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে ‘ভিসি’ অধ্যাপক সাজ্জাদ এ দুই কর্মকর্তাকেই পাঠান ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে।

জানা গেছে, এর আগে কখনো শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবসে বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফুল না দিলেও এবার ‘ভিসি’র মদদে কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিল। তিনি দায়িত্বে আসার সুযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোও ক্যাম্পাসে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে।

২০১৯ সালের ৯ মে রাজশাহীতে হিজবুত তাহরীরের পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া রুয়েটের সিএসই বিভাগের ১২ সিরিজের শিক্ষার্থী তানভীর হোসাইন গত ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে রুয়েট শাখা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক আহমেদ হোসেন, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদুল হকসহ বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান ফটকের সামনে প্রকাশ্যে মিটিং করে। সেখানে রুয়েটের সেকশন অফিসার সোহেল রানাকেও তাদের সঙ্গে দেখা যায়।

রুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মোহাম্মদ ইসফাক ইয়াসশির ইপু বলেন, ‘নাশকতা ও ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতেই ভিসি আসার পর থেকেই হিজবুত তাহরীর, ছাত্রদল ও শিবির সম্মিলিতভাবে তারা ক্যাম্পাসে মিটিং ও সংগঠিত হচ্ছে। তাদের প্রতিহত করতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করব।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুয়েটে শুদ্ধাচার কৌশল পরিকল্পনা ২০২২-২৩ বাস্তবায়নে গঠিত ছয় সদস্যের কমিটি গত ৬ ডিসেম্বর রুয়েটের বিভিন্ন দপ্তর আকস্মিক ভিজিট করেন। ওইদিন কমিটির সদস্যরা পারিষদ শাখায় গেলে ওই শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার শাহ আল বেরুনী ফারুককে অনুপস্থিত পান। কিছুক্ষণ পরই পরিদর্শন কমিটি প্রধান প্রকৌশলীর অফিসকক্ষে প্রবেশকালে আল বেরুনী ফারুক কমিটির সদস্যদের উদ্দেশ করে কটূক্তি, ঔদ্ধত্য ও অশালীন আচরণসহ কমিটির কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন। তার আচরণের বিষয়টি পরিদর্শন রিপোর্টে উল্লেখ করে অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসিসহ কমিটির অন্যরা তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।

কিন্তু ‘ভিসি’ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় শিক্ষক সমিতিসহ প্রশাসনের অন্যরা ‘ভিসি’র ওপর ক্ষুব্ধ হন। ড. সাজ্জাদ অতিরিক্ত দায়িত্বে থেকেই বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন দিবস উদযাপন কমিটিতে কর্মচারী সমিতির প্রতিনিধি রাখার কথা থাকলেও তিনি রাখেননি।

এ ছাড়া প্রতিবছর কর্মচারীদের নির্ধারিত পোশাকের জন্য নিয়ম মেনে টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তার নির্দেশেই এই খাতের বরাদ্দকৃত প্রায় ১২-১৪ লাখ আটকে দেওয়া হয়।

রুয়েট কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শুভ বলেন, ‘বর্তমান রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন এ ঝামেলা করছে, যে কারণে অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসি পোশাকের বরাদ্দকৃত টাকা দিচ্ছেন না।’

ড. সাজ্জাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দৈনন্দিন ফাইল আটকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ‘ভিসি’র কারণেই রুয়েটে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের চলমান প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে চরম জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ স্বাচ্ছন্দ্যে করার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়; সম্প্রতি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি/ব্যক্তিরা ‘কাফনের কাপড়’ পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ শিক্ষক-কর্মকর্তাকে হুমকির ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা (জিডি) গ্রহণের ক্ষেত্রে ড. সাজ্জাদের বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এ নিয়েও ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রুয়েটের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা বলেন, এই কাফনের কাপড় পাঠিয়ে হুমকি দেওয়ার পিছনে ড. সাজ্জাদের পরোক্ষ মদদ বা প্রশ্রয় রয়েছে।

আইনগতভাবে অযোগ্য ড. সাজ্জাদ-

গত ৩ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় রুয়েটের ফলিত বিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদের ডিন এই অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন প্রশাসনিক ও আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বার্থে সাময়িকভাবে ডিনের দায়িত্বের অতিরিক্ত ভিসির দায়িত্ব প্রদান করে। কিন্তু অধ্যাপক সাজ্জাদ প্রকৌশল শিক্ষাবিদ না হওয়ায় বিদ্যালয়য় শিক্ষক সমিতির নেতারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কেননা, রুয়েটের আইন-২০০৩ এর ধারা ১০ (১) মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব যিনি পাবেন তাকে অবশ্যই ‘প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণায় সম্পৃক্ত একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশল শিক্ষাবিদ হতে হবে। কিন্তু অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসির এ যোগ্যতা না থাকায় গত ৭ আগস্ট রুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. ফারুক হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. রবিউল আওয়াল লিখিত প্রতিবাদ জানান।

অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য-

রুয়েট কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ বলেন, ‘অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসি বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে উঠে-পড়ে লেগেছেন। তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের উত্থানের পদ সৃষ্টি করেছেন। আমরা দ্রুত তার অপসারণ চাই।’

রুয়েটের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান রিপন বলেন, ‘ডিনের দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতন্থি একজন শিক্ষককে এতদিন (৫ মাস) ধরে রুটিন উপাচার্যের দায়িত্বে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আওয়ামীপন্থি যোগ্য একজনকে দ্রুত ভিসি হিসেবে পদায়ন করা হোক।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রোখছানা বেগম বলেন, ‘রুয়েটে শিক্ষকদের মধ্যে ইন্টারনাল কী বিষয় তা আমরা জানি না। আমরা জাস্ট অর্ডার করে দিই। নরমালি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ইন্টারফেয়ার’ করি না। যদি অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে শিক্ষকরা আমাদের লিখিতভাবে জানাতে পারতেন। তিনি তো অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসি। তার নামের পাশে পূর্ণাঙ্গ ভিসির টাইটেল লাগাতে পারেন না।’

রুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস ফলো করতে আমাকে ভিসির গাড়ি ব্যবহার, ভিসির নামের পাশে স্বাক্ষর কিংবা দপ্তর ব্যবহার করতে হচ্ছে। দায়িত্ব পালনে ব্যক্তিগতভাবে আমার সমস্যা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বাসা বরাদ্দ কমিটি সাজেস্টের আলোকে আমি সাইন করেছি। একটি ইউনিট সংস্কারহীন অবস্থায় ছিল। সরকারকে সাশ্রয় করার জন্যই ওই সহকারী অধ্যাপকের নাম সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়ায় সেখানে সে উঠেছে।’

বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা সেটি খোঁজখবর নেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ কী? কারা কোন বিবেচনায় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তা উনারাই ভালো জানবেন। এই দায়িত্ব গিয়ে নিয়ে আসিনি। আমার কোনো অযোগ্যতা থেকে থাকলে যারা দায়িত্ব দিয়েছেন তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমি চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।’

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে