কাশিমপুর কারাগারে হামলার লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২৩; সময়: ১:০৮ অপরাহ্ণ |
কাশিমপুর কারাগারে হামলার লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : চলতি বছরের মধ্যে দেশে বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে আত্মপ্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। তার আগে প্রশিক্ষিত সদস্যসংখ্যা ৩১৩ করার লক্ষ্যে গোপন এই সংগঠনের নেতারা তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। এ জন্য পাহাড়ের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর শিবিরে বিভিন্ন ব্যাচে সদস্যদের প্রশিক্ষণও শুরু করা হয়। আত্মপ্রকাশের দিন ইন্টারনেটে প্রচারের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও চিত্রও ধারণ করে তারা, যাতে সংগঠনের আমিরসহ গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা ছিলেন।

গ্রেপ্তার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাঁদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রের তথ্য–উপাত্ত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই জঙ্গিদের হামলার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, নতুন এই জঙ্গিদের হামলার একটা লক্ষ্যবস্তু ছিল গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার। এর কারণ হিসেবে জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতাদের যুক্তি, এই কারাগারে অনেক জঙ্গি নেতা রয়েছেন। যাঁরা তাঁদের ভাষায় ‘নির্যাতিত মুসলিম বন্দী’। এই বন্দীদের মুক্ত করার নামে তাঁরা হামলা চালিয়ে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।

জঙ্গিবিরোধী অনুসন্ধান ও অভিযানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী সংগঠিত হতে শুরু করে ২০১৭ সালে। নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের সাবেক কয়েকজন এর উদ্যোক্তা। তাঁরা ২০১৯ সালে সংগঠনের নাম ঠিক করেন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া (যার বাংলা অর্থ: পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল)। এর আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকায় সদস্য সংগ্রহ শুরু করা হয়।

ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানায়, এই জঙ্গিগোষ্ঠী সদস্যদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে পাহাড়ের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলে। টাকার বিনিময়ে কেএনএফ বান্দরবানের রুমা, থানছি ও রাঙামাটির বিলাইছড়িতে তাদের শিবিরে জামাতুল আনসারের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

কেএনএফ পাহাড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন। বম জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশের উদ্যোগে এটি গঠিত হলেও তাদের দাবি, ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১ সালের শেষ দিকে কেএনএফের ক্যাম্পে এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেখানে অস্ত্র চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি, ঝটিকা ও চোরাগোপ্তা হামলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সম্প্রতি কেএনএফের একাধিক ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে যেসব কাগজপত্র উদ্ধার হয়েছে, তাতে দেখা যায়, কেএনএফের সঙ্গে তাদের ক্যাম্পে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য জামাতুল আনসারের যে চুক্তি হয়েছিল, সেটার মেয়াদ ছিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত। এই পর্যন্ত পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য তিনটি ব্যাচ পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ব্যাচে ১২ জন ও দ্বিতীয় ব্যাচে ৩১ জন এবং তৃতীয় ব্যাচে ১২ জনকে কেএনএফের ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

গত সেপ্টেম্বরে কুমিল্লা থেকে একযোগে সাত তরুণ বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তাঁদের খোঁজে নেমে র‌্যাব আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণকারী এই নতুন জঙ্গিগোষ্ঠীর হদিস পায়। এরপর গত অক্টোবরে নিখোঁজ ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। পরবর্তী সময়ে তাঁদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শিবিরকে কেন্দ্র করে বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় গত অক্টোবরে নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় র‌্যাব অভিযান শুরু করে। অভিযান-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযানের সময় পাহাড়ে কেএনএফের আস্তানায় ছিলেন জামাতুল আনসারের ৫৩ জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে ৫ জন পাহাড়ে এবং সেখান থেকে পালিয়ে আসা ২ জন কক্সবাজারে ও ১ জন ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়। বাকিরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে পাহাড়ে লুকিয়ে পড়ে। তাঁদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, এ পর্যন্ত নতুন এই সংগঠনের মোট ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি জানান, গত সোমবার ভোরে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ও তাঁর সহযোগী আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাসুকুর রহমানের কাছ থেকে একটি মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। সেই মুঠোফোনেই পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠনটির সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও পাওয়া গেছে।

গতকাল কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে র‌্যাব। ভিডিওতে সামরিক পোশাকের আদলে তৈরি পোশাক পরে একে-২২ রাইফেল ও শটগান নিয়ে প্রশিক্ষণের দৃশ্য ধারণ করা হয়। তাতে যে ২২-২৩ জনকে দেখা গেছে, প্রায় সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শরক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, কথিত সামরিক কমান্ডার শিব্বির আহমেদ ওরফে হামিদ কারছে, দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুনকেও দেখা গেছে। ভিডিও চিত্রে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের জঙ্গি রয়েছে। তবে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীরের ছবি দেখা যায়নি। তবে সোমবার কক্সবাজারে রনবীরের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া তাঁর সহযোগী আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে এই ভিডিওতে দেখা গেছে। আবুল বাশার এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং বোমার তৈরির বড় কারিগর বলে জানায় র‌্যাব।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উদ্ধার হওয়া ভিডিওতে জঙ্গিদের কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেখানো হয়েছে। সেগুলো হলো জর্দান ক্যাম্প, ডা. আহমেদ ক্যাম্প, রেতলাঙ ক্যাম্প, রামজুদান পাহাড়ের পাশে রামজুদান ক্যাম্প। এসব ক্যাম্প বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে। ভিডিওর শুরুতেই জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে দেখা গেছে। ঠিক তাঁর পেছনেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এক প্রশিক্ষককেও দেখা গেছে।

বিভিন্ন ক্যাম্পে সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে থাকা দুই সদস্যকে দেখা গেছে জানিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ভিডিওতে সাব্বির ওরফে কারসে এবং মো. দিদার ওরফে চাম্পাইকে দেখা গেছে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুটি ভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় এই দুজনকে। আর পুরো সামরিক কার্যক্রম দেখভাল করতেন গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান। ভিডিওতে সালেহ ও আল-আমিন নামের আরও দুজনকে দেখা গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া সালেহ কয়েক দিন আগে বান্দরবানে শারক্বীয়ার দুই সদস্যের কবরের সন্ধান দিয়েছিলেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জামাতুল আনসারের সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমানকে এই ভিডিও করার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। মূলত রণকৌশলগত চলাচল, চলতি পথে অস্ত্র বহন, টহলকালীন ও ব্লক করার সময় তাদের অবস্থান কেমন হবে, সেগুলো তারা ভিডিওতে রেখেছে। শত্রুর ক্যাম্পে হানা দেওয়ার সময় কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সদস্যরা অবস্থান করবেন, সেই অভিযানকারী মহড়া রাখা হয়েছে ভিডিওতে।

এই ভিডিও করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাঁদের আরও উদ্বুদ্ধ করা। সংগঠনটির সামরিক শাখায় যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাঁদের করণীয় কী হবে, সেই বিষয় সামনে রেখেও ভিডিওটি করা হয়েছে। সমতলে অবস্থানকারী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভিডিও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করাও ছিল তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য।

এই বিষয়ে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বড় কোনো হামলার মধ্য দিয়ে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের সময় ভিডিওটি প্রকাশ করতে চেয়েছিল জঙ্গিরা। এ লক্ষ্যে ওয়েবসাইটও তৈরি করতে চেয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল মূল লক্ষ্য।

প্রসঙ্গত, এর আগে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশও (জেএমবি) ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে এবং বোমার সঙ্গে প্রচারপত্র দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আইএস দাবি করে, দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবিও ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ংকর জঙ্গি হামলা চালিয়ে নিজেদের জানান দিয়েছিল। হামলার ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে ঘটনার দায় স্বীকারও করেছিল। যদিও উভয় সংগঠনই হামলার পরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানের মুখে তছনছ হয়ে যায়।

এবারের অভিযানের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলার আগে আইএসের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক তরুণ ‘হিজরতের’ নামে ঘর ছেড়েছিল। যারা পরে ভয়ংকর হামলায় অংশ নেয়। এবারও যদি কুমিল্লার সাত তরুণ নিখোঁজের জিডি গুরুত্বসহকারে নেওয়া না হতো, বড় বিপদের আশঙ্কা ছিল। এই কর্মকর্তার দাবি, নতুন এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে তাঁরা শিগগির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হবেন। সূত্র- প্রথম আলো

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে