বাবার স্বপ্ন পূরনে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে রাজশাহীর মেয়ে প্রত্যাশা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩; সময়: ১২:২৮ অপরাহ্ণ |
বাবার স্বপ্ন পূরনে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে রাজশাহীর মেয়ে প্রত্যাশা

নিজস্ব প্রতিবেদক : নারীদের ক্রিকেটে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস লেখেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই বিশ্বকাপে খেলেছেন রাজশাহীর মেয়ে আফিয়া হুমাইরা আনাম প্রত্যাশা। এই খেলায় প্রত্যাশা দলে পক্ষে ডানহাতি এই অলরাউন্ডার ২২ বলে ২৪ রান করেছেন। প্রত্যাশার খেলা দেখে উচ্ছ্বাসিত পরিবার, এলাকাবাসী ও কোচেরা। সেই সঙ্গে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এলাকার মোড়ে টাঙ্গানো হয়েছে প্রত্যাশার ছবিও।

রাজশাহী নগরীর নগরীর উপশহরের বাসিন্দা ক্রিকেটার আফিয়া হুমাইরা আনাম প্রত্যাশা খেলা দেখেছেন অনেকেই। খেলা দেখে এই প্রতিবেদকরে সাথে কথা বলেছেন- এই ক্রিকেটারের বাবা আক্তারুল আনাম ববিন, মা শাবানা খাতুন, রাজশাহী যুব ক্রিকেট স্কুলের পরিচালক জামিলুর রহমান সাদ ও কোচ আরিফিন চৌধুরী তুষার।

তাদের সবার প্রত্যাশা যে, ‘প্রত্যাশা একদিন বড় ক্রিকেটার হবে। সে অনেক পরিশ্রমি ও মেধাবী মেয়ে। সে ভালো মতই জানে দলের প্রয়োজনে কোন সিচুয়েশনে (পরিস্থিতি) কিভাবে খেলতে হবে।’ তবে প্রত্যাশার বাবা হতাশার কথা- বাংলাদেশের এতো বড় একটি খেলা দেখাইনি দেশের কোন টিভি চ্যানেলে। ফলে অ্যাপস ডাউনলোড করে মেয়ের খেলা দেখতে হয়েছে তাকে। তবুও তিনি অনেক খুশি।

একান্ত স্বাক্ষাতে ক্রিকেটার প্রত্যাশার বাবা আক্তারুল আনাম ববিন বলেন, ‘আমি একটা সময় ক্রিকেটের সাথে জড়িত ছিলাম। ইন্টার স্কুল থেকে শুরু করে রাজশাহী ফার্স্ট ডিভিশন পর্যন্ত ক্রিকেট খেলেছি। মধ্যবৃত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ার কারণে ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে নিতে পারিনি। কিন্তু আমার একটা স্বপ্ন ছিল কোনভাবে ক্রিকেট জগতে আমার কাউকে নিয়ে আসা। নিজে তো পারলাম না; একটা সময় ভাবতাম আমার ছেলে কিংবা মেয়েকে ক্রিকেট জগতে নিয়ে আসবো। এরপরে প্রত্যাশার জন্ম হলো। সে আস্তে আস্তে বড় হলো।

আমরা যখন মাঠে খেলতাম, তখন প্রত্যাশাকে নিয়ে যেতাম। বল দিয়ে বসিয়ে রাখতাম। কোন কোন সময় সে বল ও ব্যাট নিয়ে নাড়াচাড়া করতো। একটা সময় সে (প্রত্যাশা) বড় হলো। তার ক্রিকেট খেলার উপরে ভালো ঝোঁক ছিল। সেখান থেকে আমার স্বপ্নটা আরো ডানা মেলে।

তিনি আরো বলেন, আমি প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেই চেষ্টা করতাম প্রত্যাশাকে ক্রিকেটে আগ্রহী করতে। পরে আমি রাজশাহী ক্লেমনের তুষার ভাই ও সাদ ভাই এর সহযোগিতায় তাকে আস্তে আস্তে ক্রিকেট জগতে নিয়ে আসি। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন, কোচ আরিফিন চৌধুরী তুষার। পাড়া-প্রতিবেশীসহ অনেকেই সহযোগিতা করেছে। ২০১৪ সালে ঢাকায় ফার্স্ট ডিভিশন খেলার মধ্যদিয়ে প্রত্যাশা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে। ২০২০ প্রিমিয়ারে চান্স পেল। তার পরে থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে খেলা শুরু করে। সেখানে ভালো করার পরে অনুর্ধ ১৯ এর চান্স পেল।

ববিন বলেন, প্রতিবন্ধতা ছিল। মেয়ে মানুষ খেরবে বিষয়টি অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। তবে যারা বিভিন্ন কথা বলেছে, তাদের কথাগুলো দোয়া স্বরূপ বলেছে বলে আমি মনে করি। মেয়েরা সমাজ ও দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারে। তার এটাই বড় প্রমাণ। আমার মেয়ে উপশহর ঈদগা মাঠে খেলেছে। এখানে একটা ক্যাম্প করতে চাই। যাতে করে খেলাধূলায় নারীরা আরো এগিয়ে আসে। প্রত্যাশার মা শাবানা খাতুন ক্রিকেট বুঝতো না। সে কেমন কেমন করতো। তাকে আমি বুঝিয়েছে। মেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলে। সে ভালো ক্রিকেটার হলে আমাদের আর পিছনে তাকাতে হবে না। তার মা তাকে অনেক দিন প্রশিক্ষণে নিয়ে যেতে হয়েছে। সে রিক্সা বা পায়ে হেঁটে প্রশিক্ষণে গেছে। আমি তাকে ঠিকমতো টাকা দিতে পারিনি। কিছুদিন আগে প্রত্যাশাকে ৪০ হাজার টাকায় একটি পুরানো মোটরসাইকেল কিনে দেয়। ওই মোটরসাইকেলে সে প্রশিক্ষণে যাওয়া আশা করতো।

মেয়ের খেলা দেখার বিষয়ে তিনি বলেন, আজকে আমরা পরিবারের অনেক মানুষ খেলা দেখেছি। আমার কষ্টটা ওই জায়গাতে, যে বাংলাদেশের আইসিসি ওয়াল্ড কাপের মতো একটা খেলা, সেটা যেমনই হোক, অনুর্ধ ১৯ হোক, আর ন্যাশনাল পর্যায়ের হোক। এই খেলাটা আমাদের বাংলাদেশের কোন চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়নি। আমাদের অ্যাপসে ডাউনলোড করে ১০০ টাকা রিচার্জ করে খেলা দেখতে হয়েছে। আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমার মেয়ে দেশের জন্য কিছু করছে। এটা সব বাবা-মার ভাগ্যে মেলে না।

রাজশাহীর ক্লেমন ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ব্যাটিং কোচ আরিফিন চৌধুরী তুষার বলেন, ‘সে বড় মাপের খেলোয়ার হবে। প্রথম অবস্থায় তাকে ৬ মাস টিনিস বলে খেলিয়েছি। ব্যাটিং সট তার খুব ভালো। তখন আমি নিজেই আগ্রহ করে তাকে ক্রিকেট বল দেয়। তাকে বলেছিলাম তুমি ক্রিকেট বলে প্যাক্টিস করবা। এমনভাবে সে দুই বছর ক্রিকেট বলে প্যাক্টিস করেছে। প্রশিক্ষণে অনেক আগ্রহী প্রত্যাশা। প্রতিদিন সে প্রশিক্ষণে আসতো। তার খেলা দিন দিন উন্নতি হওয়ার পরে তাকে ঢাকায় আমার এক বন্ধুকে জানালাম।

আমি তাকে বলেছিলাম- মেয়েটাকে নেন। সে অনেক ভালো খেলে। তখন সে আমাকে বলেছিল, তাকে (প্রত্যাশা) এখন খেলাতে পারবে না। পরবর্তি বছরে চান্স দেবেন। তার পরেও আমি তাকে আবার বলি প্রত্যাশার বিষয়ে। তাদের একটি টুর্নামেন্টে প্রত্যাাশাকে দুই ম্যাচ না খেলিয়ে বসিয়ে রেখেছিল। তার পরে এক ম্যাচ খেলতে নেয় প্রত্যাশাকে। সেই ম্যাচে প্রত্যাশা ম্যানঅপ দ্যা ম্যাচ হয়। তারপর থেকে আর প্রত্যাশাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর পরেই ন্যাশনাল অনুর্ধ ১৮ দলে ডাক পেলো। তার একবছরের মাথায় অনুর্ধ ১৯ দলে ডাক পাই। আমি আশাবাদি ছিলাম সে বড় জায়গায় খলবে।’

রাজশাহী যুব ক্রিকেট স্কুলের পরিচালক জামিলুর রহমান সাদ জানান, ‘প্রত্যাশা যেকোন ম্যাচের সিচিয়েশন হ্যান্ডেল করতে পারে। মেয়ে মানুষ হলেও হাতে পাওয়ার আছে। আমাদের দেশে এই রকম হাইটের ক্রিকেটার পাওয়া মুসকিল। তার খেলাও ভালো। যথেষ্ট পরিশ্রমী মেয়ে। তার যুব ক্রিকেট স্কুলে প্রত্যাশার মতো সাতজন নারী ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নেয়। তাদের মধ্যে পাঁচজন ঢাকা খেলছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে