জামিনের আশায় গ্রাম থেকে পালিয়ে নগরে

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২২; সময়: ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ |
জামিনের আশায় গ্রাম থেকে পালিয়ে নগরে

পদ্মাটাইমস ডেস্ক :  পড়ন্ত বিকেল। অফিস শেষে সবার ঘরে ফেরার তাড়া। রাস্তায় যানজটে ঘুরছে না গাড়ির চাকা। হাইকোর্টের পাশের রাস্তার ফুটপাতে চা দোকানে রাজ্যের হতাশা নিয়ে সিগারেট ফুঁকছেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের সবার গ্রেপ্তারের ভয়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা পালিয়ে এসেছেন রাজধানীতে। জামিন নিতে ঘুরছেন উচ্চ আদালতে। মিলছে না মুক্তি। আলাপচারিতায় উঠে আসে পালিয়ে বেড়ানো মানুষের কষ্টকথা।

তাঁদের একজন ৪৮ পেরোনো আব্দুল মালেক। গত সোমবার নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে এসেছেন ঢাকায়। দু’দিন ধরে তাঁর হাইকোর্টে আসা-যাওয়া। ২৫ নভেম্বর রাতে গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন মালেক। হঠাৎ পুলিশ ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে জানায়, তাঁর নামে মামলা আছে। এমন তথ্য পেয়ে পুলিশকে বোকা বানিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালান তিনি। এর পর আর ফেরেননি ঘরে। পরে এলাকার এক আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি আগাম জামিন নিতে আসেন হাইকোর্টে। তবে মেলেনি জামিন। নাশকতার মামলায় তিনি অভিযুক্ত।

মালেক বলেন, মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ২২ নভেম্বর নাশকতা হয়েছে। তবে সেদিন তিনি কিশোরগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। জীবনে কখনোই রাজনীতি করেননি। বাড়িতে স্ত্রী ও তিন মেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শ্বশুরের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছি। সেই টাকাও শেষের পথে। এলাকার এক ইটভাটায় ব্যবস্থাপক পদে কাজ করা মালেকের চোখেমুখে এখন ডুবে আছে বিষণ্ণতার আঁধারে।

আগাম জামিন নিতে চাঁদপুরের মতলব উত্তর থেকে এসেছেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি মাটি কাটা ঠিকাদার। সম্প্রতি মতলব উত্তর থানায় তাঁর নামে ককটেল বিস্টেম্ফারণের অভিযোগে মামলায় হয়েছে। বাড়ির গরু বিক্রি করে সাড়ে ৮ হাজার টাকা নিয়ে তিনি গত মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন। গতকাল বুধবার আইনজীবীর সঙ্গে কথাও বলেছেন। দেলোয়ার বলেন, তিনি বিএনপি সমর্থক হলেও মিছিল-মিটিংয়ের যাননি কখনও। এখন তিনি পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

নাশকতা, পুলিশের ওপর হামলা ও গোপন বৈঠকের অভিযোগে অভিযুক্ত পাঁচজনের একটি দলের সঙ্গে দেখা হয় হাইকোর্ট আঙিনায়। তাঁরা এসেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর থেকে। সেই দলেরই একজন মো. আব্দুলল্গাহ জানান, তিনি মাছের আড়তে কাজ করেন। ১০ দিন ধরে পুলিশ বাড়িতে এসে তাঁকে খুঁজছে। কী অভিযোগে মামলা হয়েছে, তাও তিনি জানতেন না। পরে গ্রামের এক আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে
তিনি অভিযুক্ত। এ দলের আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁর ধারণা, পত্রিকায় নাম প্রকাশ হলে আরও মামলা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘টুকটাক চাষাবাস আর চা দোয়ান করি, সংসার চালাই। ৭-৮ বছর আগে বিএনপি কইত্তাম। অন রাজনীতি ছাড়ি দিছি। হাঁচ ওক্ত নামাজ হড়ি। তার পরও বাইচতাম হাইলল্গাম না। আঁর বিরুদ্ধে মামলা করি দিছে।’

এমন দীর্ঘশ্বাস আর হয়রানির অসংখ্য গল্প এখন ঢাকার আদালতপাড়ায়। কেউ কোনো রাজনীতির সঙ্গে না জড়িয়েও হয়েছেন গায়েবি মামলার আসামি। আবার কেউ রাজনীতির কারণে একাধিক মামলার আসামি হয়ে আগাম জামিনের আশায় ঘুরছেন। কারও কারও জামিন মিললেও কমছে না ভিড়। গত এক সপ্তাহে আদালত চত্বরে বিএনপি নেতাকর্মী ও নিরীহ মানুষের আনাগোনা অনেকটাই বেড়েছে। জামিন আবেদনের শুনানির লম্বা সারির কারণে নানা ভোগান্তিতে সময় কাটাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। ক্লান্ত শরীরে কেউ কেউ বসে পড়ছেন আদালতের বারান্দায়। আবার কেউ বসছেন খোলা আকাশের নিচে গাছতলায়।

হাইকোর্টের অ্যানেক্স (বর্ধিত) ভবনের সামনে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক মানুষ জটলা বেঁধে বসে আছেন। কথা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে আসা এক ব্যক্তির সঙ্গে। পরিচয় জানতে চাইলে লজ্জা পান। বলেন, ‘ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়েছি। নাতি-নাতনি আছে। হঠাৎ একটি মিথ্যা মামলার আসামি হতে হয়েছে।’ এর বেশি আর বলতে রাজি হননি তিনি।

পাশে বসে থাকা আবদুর রহমান দক্ষিণখান থানা বিএনপির কর্মী। তিনি জানান, তাঁর নামে ১০টি মামলা আছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় জামিন নিতে এসেছেন। পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে তিনি মাসের পর মাস ঘরছাড়া।
গ্রেপ্তার এড়াতে আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে আসা অধিকাংশ ব্যক্তিই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী।

গত দুই মাসে বিএনপির প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী জামিন নিয়েছেন। নেতাকর্মীরা জানান, মিথ্যা, বানোয়াট ও গায়েবি মামলায় তাঁদের আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। কারও কারও দাবি, যেসব মামলায় তাঁদের আসামি করা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা নেই। শুধু প্রতিহিংসার জেরে তাঁদের আসামি করা হয়েছে।

বিএনপির হিসাবে ২২ আগস্টের পর থেকে গত তিন মাসে দেশের ৫৮ জেলায় তিন শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজার নেতাকর্মী। আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। রয়েছে অচেনা আসামির তালিকাও।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের যুবদল কর্মী আব্দুল মান্নান নাশকতার মামলায় আসামি হয়ে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিতে ঢাকায় আসেন গত সোমবার। তিনি এখন ফুটপাতে রাত কাটাচ্ছেন। বিমানবন্দর থানা বিএনপির নেতা জুলহাস পারভেজ বলেন, গত দুই মাস তিনি ঘরছাড়া। ২২ মামলার আসামি জুলহাস আগাম জামিন নিতে এসেছেন।

এনেক্স ৭, ১২ ও ১৬ নম্বর বিচারকক্ষের সামনেও শত শত আগাম জামিনপ্রার্থীর ভিড়। তাঁরা এজলাসের বাইরের বারান্দা ও ভেতরের খোলা মাঠে নিজেদের আবেদনের শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছেন।

গত মঙ্গলবার ভাঙচুর ও নাশকতার ২৭ মামলায় ১২ জেলার ৪৩৮ বিএনপি নেতাকর্মীকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন দেন হাইকোর্ট। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে আহত করার অভিযোগে করা মামলায় লক্ষ্মীপুরের ১১ ছাত্রদল নেতাকে গত ৪ ডিসেম্বর ৬ সপ্তাহের জামিন দেন হাইকোর্ট। এভাবে গত এক মাসে উচ্চ আদালতের চারটি বেঞ্চ কয়েক হাজার নেতাকর্মীর আগাম জামিন মঞ্জুর করেন।

আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, এসব মামলায় ৬ সপ্তাহের মধ্যে সংশ্নিষ্ট নিম্ন আদালতে আসামিদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন হাইকোর্ট। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের হয়রানি করতে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। গায়েবি মামলার কারণে উচ্চ আদালতে জামিনপ্রার্থীদের আসতে হচ্ছে। মামলার ঘটনা ও অভিযোগের কোনো অস্তিত্ব নেই।

হাইকোর্টের চারটি বেঞ্চকে আগাম জামিনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সব বেঞ্চেই প্রতিদিন জামিন দেওয়া হয় না। আগাম জামিনের জন্য দিন, তারিখ নির্ধারণ রয়েছে। সেই হিসাবে আদালত এলাকায় জামিনপ্রার্থীদের আনাগোনা বাড়ছেই।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে